প্রতীকী ছবি

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার সাহিত্যই গড়ে ও বেড়ে উঠেছে— কবিতাকে আশ্রয় করে। ইতিহাস ও সাহিত্তবেত্তারা আমারদের সেই তথ্যই দেন। আরবি সাহিত্যও ঠিক এভাবে গতি পেয়েছে।

মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে আরবে কাব্যধারাটিই ছিল অত্যধিক প্রচলিত; শৈল্পিক ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ। তাই পবিত্র কোরআনে সাহিত্যপ্রসঙ্গ বোঝাতে শের বা কবিতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং নিম্নোক্ত আলোচনায় কবি বলতে কবি-সাহিত্যিক এবং কবিতা বলতে পদ্য ও গদ্য উভয়টি বুঝতে হবে।

পবিত্র কোরআনুল কারিম মূলত হেদায়েত ও দিকনির্দেশনা গ্রন্থ। তবে গৌণ ও মৌনভাবে অন্য বিষয়গুলোও এতে স্থান পেয়েছে। কাব্য বা সাহিত্যও তেমন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়।

ইসলাম প্রচারে প্রতিবন্ধকতা ও বিঘ্ন তৈরির লক্ষ্যে কাফেররা রাসুল (সা.)-এর ওপর অনেকগুলো বিশেষণ আরোপ করেছিল। তার মধ্যে শায়ের বা ‘কবি’ শব্দটি অন্যতম। কাফেররা মূলত  কোরআনকে কবিতা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই প্রতিবাদ-প্রত্যুত্তরে ‘কবি ও কবিতা’ প্রসঙ্গটি বাহ্যত নেতিবাচক বর্ণনাভঙ্গিতে পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। কোরআনের বর্ণনাশৈলী সম্পর্কে অনভিজ্ঞ যে কেউ মনে করতে পারে, কাব্যচর্চা কোরআনে অনভিপ্রেত; কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু নয়।

কাব্য ও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী কী— তা স্বল্পবিস্তারে সুরা আশ-শুআরায় বিধৃত হয়েছে। এ সুরার নামকরণের (আশ-শুআরা অর্থ কবিগণ) মাধ্যমেই বোঝা যায়, ইসলামে কাব্য ও সাহিত্যের গুরুত্ব কতখানি।

আল্লাহতায়ালা বলেন— 

...বিভ্রান্তরা কবিদের অনুসরণ করে। আপনি কী দেখেন না, তারা প্রতিটি উপত্যকায় উভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন সব কথাবার্তা বলে, যা তারা করে না। তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম সাধন করে ও আল্লাহকে অত্যাধিক স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

(সুরা আশ-শুআরা, আয়াত : ২২৪-২২৭)

প্রসঙ্গত, পবিত্র কোরআনে কোনো বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করার জন্য আগে নেতিবাচক দিক ও পরে ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরা হয়। নেতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রসঙ্গটি স্বকৃত ও দেদীপ্যমান করা কোরআনের বর্ণনাশৈলী। আর এর মাধ্যমে আয়াতগুলোতে কাফের কবিদের নিন্দা ও মুমিন কবিদের স্তুতি বর্ণনা করা হয়েছে।

কোরআনের প্রায় সব তাফসিরবিশাদরা একমত যে, এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে কাব্যচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। বরং ঈমানদার কবিদের দিকনির্দেশনা দিয়ে তাদের কাব্যচর্চা আরও পরিশীলিত ও বেগবান করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারিতে আছে, এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, হাসসান বিন সাবিত, কাব ইবনে মালিক (রা.) প্রমুখ সাহাবি অশ্রুসিক্ত বদনে রাসুল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হন। তারা প্রিয়নবী (সা.)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তাআলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। কিন্তু আমরা তো কাব্যচর্চা করি। এখন আমাদের কী উপায় হবে? রাসুল (সা.) বলেন, আয়াতের শেষাংশ তিলাওয়াত করো। এ আয়াতের উদ্দেশ্য হলো- তোমাদের কাব্যচর্চা যেন সার্থক হয় এবং অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্য-আশ্রিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লিখিত ব্যতিক্রমীদের অন্তর্ভুক্ত।’

উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত, কোরআনে কাব্যচর্চা নিষেধ করা হয়নি। বরং কাব্যচর্চা যেন অশুভ ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি অধিক কল্যাণপ্রসূ ও পুণ্যময় করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।