বাফালোর জাকারিয়া মসজিদ। ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বাফালো। এটি পশ্চিম নিউইয়র্কের বৃহত্তম শহরও বটে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শহরটির জনসংখ্যা দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩০৪ জন। মোট আয়তন ২ হাজার ৫২৫ বর্গ কিলোমিটার।

প্রান্তিক নগরী বাফালোর অবস্থান নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ১৬ মাইল (২৬ কি.মি.) দক্ষিণে। নায়াগ্রা নদীর তীরে ইরি হ্রদের পূর্ব তীরে। বৈদ্যুতিক শক্তির প্রাথমিক অন্তর্ভুক্তি শহরটিকে ‘দ্য সিটি অফ লাইট’ (আলোর শহর) নামে পরিচিতি দিয়েছে।

বাফালো ইরি কাউন্টির কাউন্টি আসন ও দ্বি-দেশীয় নায়াগ্রা অঞ্চলের অংশ। ফলে কানাডার সীমান্তজুড়ে বাণিজ্য ও ভ্রমণের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবেও বিবেচিত। ১৭ শতাব্দীর আগে বাফালো অঞ্চলটি আদি আমেরিকান ইরোকোকাইস উপজাতি ও পরে ফরাসী উপনিবেশকারীদের অধ্যুষিত ছিল। অভিবাসন, ইরি খাল ও রেল পরিবহন এবং ইরি হ্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে গত দুই দশকে শহরটিতে জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরিবেশ ও প্রকৃতির কারণে জাদুর শহর হিসেবেও পরিচিত। নিউইয়র্ক থেকে দূরত্ব ৩৭৫ মাইলের। বাফালো সিটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিটের মতো। কারণ নিরিবিলি এ শহরের কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই।  

যেভাবে মুসলিম শহর হয়ে উঠছে বাফালো
আশ্চর্যরকম ও অবিশ্বাস্য শোনালেও বাস্তবতা হলো- বাফালো ক্রমে মুসলিম শহর হয়ে উঠছে। অনেকের কাছে বাফালো ‘মসজিদের শহর’ হিসেবেও বিখ্যাত। যেমনটা খ্যাতি রয়েছে— বাংলাদেশের ঢাকা ও তুরস্কের ইস্তাম্বুলের।

বাফালোর অধিকাংশ গির্জায় নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিনই এসব গির্জায় মুসলিমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। নামাজ আদায়ে মুসল্লিদের সমাগমও বাড়ছে দিনদিন।

বলতে গেলে- সব মিলিয়ে মুসলিম শহর হিসেবে গড়ে উঠছে বাফালো। মুসলিম নারী-মেয়েরা মাথায় হিজাব পরে চলাফেরা করেন। হিজাবের আধিক্যের কারণে এ শহরকে হিজাবের নগরীও বলা হয়। অনেকের দেওয়া তথ্য মতে, ইসলামি আইন-কানুনের যথাযথ ব্যবহার ও মুসলিম পরিবেশ বিদ্যমান থাকার ফলে সন্ত্রাসসহ নানাবিধ অসুবিধা থেকে মুক্ত এই শহর।

গির্জাগুলো পরিণত হচ্ছে মসজিদে
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে- পুরো বাফালো সিটি একসময় ধর্মের নগরী ছিল। তখনকার লোকেরা বেশ ধর্মকর্ম (খ্রিস্টধর্ম) করতো। কিন্তু বর্তমানে তারা উল্টো পথে হাঁটছেন। ফলে কিছু কিছু গির্জায় তাদের উপস্থিতি শূন্যের কোঠায়। তাই গির্জা কর্তৃপক্ষ একপ্রকার বাধ্য হয়েই মুসলিমদের কাছে গির্জাগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন। মুসলিমরাও গির্জা-চার্চগুলো কিনে মসজিদ বানাচ্ছেন। মাদরাসা ও ইসলামিক সেন্টার তৈরি করছেন।

বাংলাদেশি ও অন্য মুসলিমদের বসবাস
বাফালোর ইস্ট সাইট এলাকায় জাকারিয়া মসজিদ ও মারকাজকে ঘিরে বাংলাদেশিদের বসতি-আবাস। এছাড়াও আশপাশে কয়েকশ’ ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বার্মিজ মুসলিম পরিবারের বাড়িঘর রয়েছে। আরও আছে সৌদি আরব, ইয়েমেন, আরব আমিরাত ও ভারতের মুসলিম জনসংখ্যাও।

নিউইয়র্কের তুলনায় কম খরচে বসবাসের সুবিধা রয়েছে এ শহরে। ফলে তুলনামূলক নতুন অভিবাসী মুসলিমরা এ শহরে নিবাস গড়ে তুলতে শুরু করছেন। জানা গেছে, নগদ অর্থ দিয়ে তারা বাড়িঘর কিনছেন। সুদের মতো জঘন্যতম হারাম কাজ থেকে মুক্ত থাকছেন। সব মিলিয়ে মুসলিমদের আগমনের ফলে বাফালোর মানচিত্রে আসছে— দারুণ ও অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।

মসজিদ-মাদরাসা ও ইসলামিক অ্যাকাডেমি
শহরটিতে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। ফলে লোকজন নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মিলেমিশে বসবাস করতে পারেন। মুসলিমদের ধর্ম-কর্ম করতে ও ধর্মীয় রীতি-আচার পালনে কোনো প্রকার বিঘ্ন তৈরি হয় না।

যে কারণে, বেশ কিছু মসজিদ-মাদরাসার উপস্থিতির সঙ্গে ইসলামি আবহ-পরিবেশ বিদ্যমান সেখানে। আজানের সময় বাফালোর বিভিন্ন মসজিদ থেকে একসঙ্গে ভেসে আসে আজানের হৃদয়গ্রাহী সুর। ইথারে ভাসা সে সুমধুর শুলে মনে হবে— এই ছিমছাম ও নিরিবিল এ শহরটি  যেন কোনো মুসলিম দেশের সবুজ-সজীব ভূখণ্ড।

বাফালোতে বর্তমানে ১৭টি জামে মসজিদ রয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের ৪টি নামাজঘরসহ (ইবাদত খানা) বিশাল জায়গা নিয়ে ৫টি উচ্চ শিক্ষার মাদরাসাও রয়েছে। এছাড়াও গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি হেফজখানা। যেখানে পবিত্র কোরআনের ভালো মানের হাফিজ তৈরি করা হয়।

এছাড়াও হালাল খাবার ও পানীয়ের জন্য বিভিন্ন রেস্টুরেন্টও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। যেখান থেকে মুসলিমরা নিজেদের চাহিদা মত খাবর-পানীয় সংগ্রহ করতে পারেন পাশাপাশি কোনো অনুষ্ঠানও আয়োজন করতে পারেন। (অ্যা গাইড টু হালাল ইন বাফালো, ভিজিট বাফালো-নায়াগ্রা : ২১/১১/২০১৯) 

শহরের বড় জেলখানাটি এখন নারী মাদরাসা
প্রতিটি মুসলিম পরিবারই তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে মসজিদে আসেন। নামাজ আদায়ের পাশাপাশি ধর্মীয় আলোচনায় শামিল হন। প্রতি শুক্রবারে নারীরাসহ পরিবারের অধিকাংশরাই শহরের মসজিদে মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় করেন।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বাফালোর পুরাতন পুরো জেলখানাটিই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ আবাসিক/অনাবাসিক নারী মাদরাসায় পরিণত হয়েছে। যেখানে ইসলামি শিক্ষাকার্যক্রমের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাকার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত সিলেবাসও অন্তর্ভুক্ত। প্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ শিক্ষক ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রিধারী।

পুরো আমেরিকার মধ্যে বাফালো হচ্ছে- মুসলমানদের বসবাসের জন্য সর্বসেরা শহর। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ শহরের অনেক অধিবাসী এমনটা বলেছেন।

ভারতীয়দের মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা ও তাবলিগ জামাত
এক ভারতীয় ধার্মিক চিকিৎসক বাফালোতে প্রতিষ্ঠা করেন— জাকারিয়া দারুল উলুম মাদরাসা। ২৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের মাদরাসাটিতে বর্তমানে পাঁচশর বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাসকে তারা আমেরিকার মূলধারার সিলেবাসের সঙ্গে সমন্বয় করেই সার্বিক কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন।

এছাড়াও জাকারিয়া দারুল উলুম মাদরাসার নারী শাখায় প্রায় আড়াই শত ছাত্রী রয়েছে। তারাও ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে আলেমা-হাফেজা হচ্ছেন। তাদের জন্য সেখানে থাকা-খাওয়াসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

বাফালোর মারকাজ মসজিদ— তাবলিগ জামাতের প্রধান কার্যালয় হিসেবে পরিচিত। প্রতি শুক্রবার মাগরিবের নামাজের পর এখানে মুসল্লিদের উদ্দেশে বিশেষ বয়ান করা হয়। এই মসজিদে বাংলাদেশিদের আসা-যাওয়া বেশি। মসজিদের ইমাম-খতিব ও মুয়াজ্জিনসহ প্রায় ৯০% মুসল্লি বাংলাভাষী। বিয়ে-ওলিমা ও আকিকাসহ ধর্মীয় যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান এখানে সম্পন্ন হয়। এ মসজিদকে ঘিরে সেসব কিছুর ব্যবস্থা রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

বাফালোর উল্লেখযোগ্য মসজিদ
বায়তুল মোকাররম মসজিদ, মারকাজ মসজিদ, জাকারিয়া মসজিদ, মসজিদে তাকওয়া, মসজিদ আল-ঈমান, আল-হুদা মসজিদ, বাইতুল মামুর মসজিদ, লাককুওয়ানা ইসলামিক মসজিদ (ইয়েমেনি), বার্মিজ মসজিদ, কান্যাক্টিকাট ও মিনার মসজিদ।

প্রসঙ্গত, জাকারিয়া মসজিদটি আগে বিশাল গির্জা ছিল। গত শতাব্দীর শেষ ভাগে মুসলিমরা গির্জাটি কিনে নিয়ে মসজিদে রূপান্তর করেন। ২০ হাজার স্কয়ার ফিটের এ মসজিদে প্রায় বারোশ’র বেশি মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।