প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন রমজান মিয়া জামে মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি চৌধুরী মসজিদ নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিক এ মসজিদটি নির্মিত হয় প্রায় ৩০০ বছর আগে মোঘল আমলে। মসজিদটি নিয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে আছে নানা কাহিনী। সঠিক নজরদারি এবং অপরিকল্পিত সংস্কার কাজের কারণে এর স্থাপত্যকলা নষ্ট হওয়ার পথে। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে মোঘল আমলে নির্মিত মসজিদটির ইতিহাস-ঐতিহ্য। 

নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার বাটইয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দৌলতরামদি গ্রামে অবস্থিত রমজান মিয়া জামে মসজিদটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করে আছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই ঐতিহাসিক পুরোনো এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি দেখতে আসেন। 

মসজিদটি মোঘল আমলের স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। স্থানীয়দের মতে, ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ কিংবা তারও আগে পাঁচ শতাংশ জমির ওপরে মরহুম রমজান মিয়া মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৩১ ফুট দৈঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের এ মসজিদের ছাদে মাঝ বরাবর একটি এবং দুই পাশে দুটি গম্বুজ রয়েছে যা পুরো ছাদকে ঢেকে রেখেছে।

গম্বুজগুলো মোঘল স্থাপত্য কলার আদলে বিভিন্ন কারুকাজ মণ্ডিত। মসজিদটির সামনের দিকে রয়েছে তিনটি প্রবেশদ্বার। এর মধ্যে একটি বড় ও অন্য দুইটি ছোট আকারের। চার ফুট চওড়া দেয়ালগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন কারুকার্যের চিহ্ন। পশ্চিম পাশের দেওয়ালে রয়েছে একটি বড় এবং দুটি ছোটসহ তিনটি মিম্বর। ১২টি পিলার ও দুটি খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির ছাদে প্রত্যেক মাথায় একটি করে মিনার রয়েছে, যার মধ্যে চারটি বড়।

আমরা এই মসজিদের মক্তবে পড়ালেখা করেছি। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মসজিদে মক্তব বন্ধ আছে। মসজিদ সংস্কার করতে না দেওয়ায় এই মসজিদকে ঘিরে আশপাশে চারটি মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। আমাদের সমাজ ছিল একটা কিন্তু বর্তমানে মসজিদটি সংস্কার না হওয়ার কারণে চার/পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। -স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল হাসান পিয়াস

 

৩০ জনের বেশি মুসল্লির জায়গা না হওয়ার কারণে মসজিদটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের কথা উঠলেও পুরোনো স্থাপত্যের নিদর্শন স্বরুপ এখনো সংরক্ষণ করা হয়েছে। 

ঐতিহাসিক এ মসজিদটির নির্মাণশৈলী অত্যন্ত চমৎকার। শুরু থেকে ইট, বালু, চুন-সুরকি দ্বারা এটি নির্মিত। যদিও পরে একাধিকবার এর সংস্করণ করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে বাইরে সিমেন্টের প্লাস্টার এবং ভেতরে টাইলসের কাজ করা হয়েছে।

পাশের উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে আসা মো. সাহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার খালার বাড়ি এখানে। আমি বেড়াতে আসলেই এই মসজিদে নামাজ পড়ি। প্রাচীন মসজিদ হওয়ায় আমার আলাদা টান কাজ করে।

ইট-সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদে বড় বড় তিনটি গম্বুজ রয়েছে। ভেতরে দুই সফ (কাতার) রয়েছে যেখানে ৩০ জন নামাজ পড়তে পারে। মসজিদটি অনেক পুরাতন ও প্রাচীন তাই এর সংস্কার করা জরুরি। -মসজিদের বর্তমান ইমাম হাফেজ আবদুল আজিজ

 

স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল হাসান পিয়াস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এই মসজিদের মক্তবে পড়ালেখা করেছি। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মসজিদে মক্তব বন্ধ আছে। মসজিদ সংস্কার করতে না দেওয়ায় এই মসজিদকে ঘিরে আশপাশে চারটি মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। আমাদের সমাজ ছিল একটা কিন্তু বর্তমানে মসজিদটি সংস্কার না হওয়ার কারণে চার/পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। 

বংশ পরম্পরায় মো. আবু জাহের ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ আদায় করছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ পড়ছি। আমার দাদা ও তার পূর্বপুরুষরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করছেন। 

মসজিদের বর্তমান ইমাম হাফেজ আবদুল আজিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইট-সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদে বড় বড় তিনটি গম্বুজ রয়েছে। ভেতরে দুই সফ (কাতার) রয়েছে যেখানে ৩০ জন নামাজ পড়তে পারে। মসজিদটি অনেক পুরাতন ও প্রাচীন তাই এর সংস্কার করা জরুরি। 

মসজিদের সাবেক সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রায় ৩০০ বছর আগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতাদের নাম ছিল শায়খ নূরুল্লাহ চৌধুরী ও শায়খ মুজীর আলী চৌধুরী। বর্তমান চৌধুরী বাড়ির লোকজন মসজিদের উন্নয়ন কাজ করতে দেন না। আমি মসজিদের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে হুমকির শিকার হয়েছি। আমার ছোট ভাইকে রক্তাক্ত করা হয়েছে।’

মসজিদের কোষাধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মসজিদের বর্তমান সভাপতি ও মোতায়াল্লি শরিফ উল্যাহ চৌধুরী বাবু। আমরা মসজিদের সংস্কার করতে চাচ্ছি। অর্থের অভাবে কাজ করতে পারছিনা। মসজিদটিকে বর্ধিত করা দরকার। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি এগিয়ে এলে আমরা উপকৃত হবো।’ 

বাটইয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন শাহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চৌধুরী বাড়ির সামনে অথবা চৌধুরীর বাড়ির আন্তরিকতার কারণে মসজিদটি নির্মাণ হয়েছে। বর্তমানে তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে মসজিদটি পরিচালিত করতে চাইছেন। তাই একটা সমাজ ভেঙে ৫০০ মিটারের মধ্যে তিন/চারটা মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। আমি চেয়ারম্যান হয়েছি ছয় মাস।  প্রাচীন এই স্থাপনার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে অবশ্যই মসজিদটির সংস্কার হোক তা আমি চাই।’

কবিরহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতিমা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুরোনো যেকোনো কিছু আমাদের কাছে ঐতিহ্য বহন করে। প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাহায্য চাই। আমরা মসজিদটির সংস্কারে কাজ করতে চাচ্ছি। আমি নিজেই উদ্যোগ নেবো এটা কিভাবে সংস্কার করা যায়। যেনো নতুন প্রজন্মের কাছে এটা সুন্দর স্থাপনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়।’ 

হাসিব আল-আমিন/এনটি