১৯৭০ সালের ২৩ অক্টোবর শুক্রবার নীলফামারী সদরের একটি চারচালা কুঁড়ে ঘরের মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকজন সফরসঙ্গী। সেই থেকে গত ৫১ বছর জাতির পিতার স্মৃতি বহন করে চলেছে মসজিদটি। 

তবে অর্ধশতাব্দির বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখলেও মসজিদটিতে নেই কোনও সরকারি সুবিধা। অর্থের অভাবে ইমাম, খতিব ও মুয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা নিয়ে টানাপোড়েন লেগে থাকে বলে দাবি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৭০ সালে নিবাচর্নী জনসভার (প্রচারণা) জন্য নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আসেন বঙ্গবন্ধু। আসার পথে চারচালা কুঁড়ে ঘরের মসজিদটিতে নামাজ পড়েন তিনি। তখন কাঁচা ঘরটিতেই স্থানীয়রা নামাজ আদায় করতেন। 

বঙ্গবন্ধু এ মসজিদে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় স্থানীয় উমর শেখের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন- 'আমার জন্য দোয়া করবেন, আমার দল ক্ষমতায় এলে পাকা মসজিদ বানিয়ে দেবো।'  তখন মসজিদটির কোনও নামও ছিল না। এরপরই মসজিদটির নতুন নাম রাখা হয় শেখ জামে মসজিদ।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর স্থানীয়রা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে কথা রেখেছিলেন তিনি। মসজিদ নির্মাণে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। ওই টাকায় ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের একটি পাকা টিনশেড মসজিদ ঘর নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যু বার্ষিকীতে এই মসজিদটিতে বিশেষ মোনাজাত ও মিলাত অনুষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে ২০১৪ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দেই নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটির বর্তমান অবকাঠামো। তবে মসজিদটির উন্নয়নে নতুন করে সরকারি সহযোগিতার জন্য বারবার বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও কোন লাভ হয়নি। এদিকে মসজিদের মুসল্লির দানের টাকায় ইমাম, খতিব ও মুয়াজ্জিনের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে মসজিদটির পরিচালনা কমিটি।

তৎকালীন সময়ে মসজিদটির নামকরণে উপস্থিত ছিলেন- পশ্চিম কুচিয়ার মোড় এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও শেখ জামে মসজিদের সহ-সভাপতি ওসমান গনি টুলু।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন নীলফামারী এসেছিলেন তখন আমার বয়স ছিল ১০-১২ বছর। গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু চারচালা কুঁড়েঘরে নামাজ আদায় করতে আসেন। তখন কাঁচা ঘরটিতে নামাজ আদায় করতেন অনেকে, কোনও নাম ছিল না মসজিদের। খড়ের ঘর দেখে বঙ্গবন্ধু আমার চাচা উমর শেখের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন, আমার জন্য দোয়া করবেন, আমার দল ক্ষমতায় এলে পাকা মসজিদ বানিয়ে দেবো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক কাতারে নামাজ আদায় করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। নামাজ শেষে তিনি সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক ও মোলাকাত করে মসজিদের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সেদিনই সর্বসম্মতিক্রমে নামকরণ করা হয় শেখ জামে মসজিদ। 

তিনি বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সৈয়দপুরের ডা. জিকরুল হক, মো. আলিম উদ্দিন, জেলা শহরের আফসার আলী, ডোমার উপজেলার আব্দুর রব, জলঢাকা উপজেলার আমিন বিএসসি ও আজহারুল হক।

মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল খালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ মসজিদে ২ থেকে ৩ বছর ধরে পেশ ইমাম ও খতিব হিসেবে আছি। আদৌ সরকারের কাছ থেকে চার আনি পয়সা পাইনি। আমরা একাধিকবার সরকারের দারস্থ হয়েছি, অফিস আদালত ঘুরেছি তারা আশ্বাস দেয়, কিন্তু কিছু করে না।

মসজিদের মুয়াজ্জিন সয়ফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরবঙ্গে শেখ মসজিদ নাম পরিচিত এটি। মসজিদে জায়গা হয় না, তাই মুসল্লিদের কষ্ট হয়, মসজিদের দ্বিতীয়-তৃতীয় তলার কাজ তাড়াতাড়ি শুরু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমদের বেতন ভাতার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। 

মসজিদের সভাপতি আব্দুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এই মসজিদে আমরা কোনও সহযোগিতা পাই না। মসজিদে ইলেক্ট্রিক বিল, বেতন মিলে মাস শেষে দেখা যায় আমার পকেট থেকেও কিছু দিতে হয়। এছাড়াও শুক্রবারে একতলার মসজিদটিতে জায়গা হয় না। দোতলার কাজের জন্য অনেক দৌঁড়ালাম, কিন্তু কাজ হয়নি। সবাই যদি একটু নজর দিত তাহলে মসজিদটি আরও দৃষ্টিনন্দন হতো।

জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছেন এবং কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। জাতির পিতার নাম অনুসারে এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। এই মসজিদের উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। 

এনটি