একটি মাদরাসায় কোরআন তেলাওয়াত করছে মরক্কোর তিঙ্গির নামের একটি গ্রামের মেয়েরা, ছবি : সংগৃহীত।

ভূমধ্যসাগরের উত্তরে ও ভারত মহাসাগরের পূর্বে অবস্থিত বিচিত্র মহাদেশ আফ্রিকা। এটি আয়তন ও জনসংখ্যা উভয় বিচারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ। এখানেই বসবাস করে বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। মুসলমানদের প্রথম হিজরতের স্থানও ছিল আফ্রিকার আবিসিনিয়া।

আফ্রিকার সবচেয়ে পশ্চিমের দেশ মরক্কো। এটি দুই সাগরের দেশ বলেও পরিচিত। দেশটির পূর্বে আলজেরিয়া, উত্তরে ভূমধ্যসাগর ও স্পেন, পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। এর বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশ মুসলমান৷ 

 মরক্কোতে জনবসতি

খ্রিস্টপূর্ব আট হাজার বছর আগে মরক্কোতে জনবসতি গড়ে ওঠে। তখন দেশটি অনুর্বর আর বৃষ্টিপাতহীন শুষ্ক মরুভূমি ছিল। বারবার, ফোনেশীয়, ইহুদি ও সাব-সাহারার লোকজন ক্রমান্বয়ে বসতি গড়ে এখানে। শুরু থেকেই বারবারদের প্রাধান্য ছিল। ফোনেশীয়রা ছিল বণিক জাতি, প্রাচীনকালে তারাও কিছুটা প্রাধান্য বিস্তার করে। ফলে রোমানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে এটি রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পঞ্চম শতকে রোমানরা সরে গেলে পূর্ব জার্মান বংশোদ্ভূত ভেন্ডাল আর গ্রিক বাইজেন্টাইনরা পর্যায়ক্রমে দেশটি শাসন করে।

 মরক্কোতে ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন

খুলাফায়ে রাশেদিনদের শাসনকাল শেষে ক্ষমতায় আসেন হজরত মুয়াবিয়া (রা.)। তিনি সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রকে ১০টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক প্রদেশের জন্য পৃথক পৃথক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি মিসর ও উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা হিসেবে যথাক্রমে হজরত আমর ইবনে আস ও হজরত উকবা বিন নাফেকে দায়িত্ব দেন।

এ সময় রোমক শাসকরা আফ্রিকার অঞ্চলগুলো পুনর্দখল করে নেয়। অত্যাচার শুরু করে স্থানীয় বার্বার অধিবাসীদের প্রতি। ফলে বার্বার জনগোষ্ঠী অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। সাহায্যের জন্য চারদিকে হাহাকার করতে থাকে। অতঃপর তারা নিকটবর্তী মিসরের শাসনকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। 

তখন মিসরের শাসনকর্তা আমর ইবনে আস হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে এ ঘটনা জানান। ঘটনার বাস্তবতা শুনে চরম ব্যথিত হন হজরত মুয়াবিয়া (রা.)। সেনাপতি হজরত ওকবা ইবনে নাফের নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী আফ্রিকার দিকে প্রেরণ করেন। এই বাহিনী সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আফ্রিকাকে আরবদের করতলগত করেন। এর মাধ্যমে রোমানদের হটিয়ে সাহাবি হজরত মুআবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে (৬৮৩ খ্রি.) সাহাবি উকবা ইবনে নাফে (রা.)-এর নেতৃত্বে মরক্কোয় ইসলামের আগমন ঘটে।

ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মরক্কো প্রাথমিকভাবে ইফ্রিকিয়া প্রদেশ হিসাবে সংগঠিত হয় এবং সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে নির্ধারিত গভর্নর কর্তৃক শাসিত হয়। ইসলাম আগমনের ফলে আদিবাসী বার্বার উপজাতিরা ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মুসলিম প্রশাসনকে ইসলামি আর্থিক কর (জাকাত) প্রদান করত।

মরক্কো বিজয়ের পর মুসলমানরা কোনো স্থানীয় বার্বারকে ধর্মান্তরে বাধ্য করেনি। ইতিহাসের পাতায় মুসলিম কিংবা অমুসলিম কোনো সূত্রেই বার্বারদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না।

প্রকৃতপক্ষে, বেশির ভাগ বার্বার ইসলামের রীতিনীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে ব্যাপক আকারে বার্বারদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মুসলিম শক্তিকে দিয়েছে নতুন প্রাণ।

দীর্ঘ ১০০ বছরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও কলোনিকে একত্র করে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ইসলাম এখানে নিয়ে আসে উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নত জীবনাচরণ। উন্নত আরবীয় সংস্কৃতিতে ছাপিয়ে যায় বারবার আর যাযাবর জীবন।

১৬৬৬ সালে বর্তমান বাদশাহর পূর্বপুরুষরা আসার আগে কয়েক শ বছরে দেশটিতে নানা উত্থান-পতন হয়। আব্বাসি ও উমাইয়া খিলাফতের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রাজত্বের উদ্ভব ঘটে। শেষের দিকে স্পেনে মুসলমানদের পতন প্রভাবিত করে দেশটিকে। খ্রিস্টান আগ্রাসনের কবলে পড়ে মরক্কো। আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ১৬৬৬ সালে আলউতি রাজবংশ (বর্তমান রাজবংশ) দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

ফরাসি উপনিবেশ 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপীয় সাতটি দেশের মধ্যে শুরু হয় আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশ উপনিবেশ আকারে করায়ত্ত করার মাধ্যমে আফ্রিকা দখলের প্রতিযোগিতা। এসময় ফ্রান্স আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে নতুন করে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন করে। ১৯১২ সালে ফরাসি ও স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শক্তি মরক্কোকে ভাগ করে নেয়।

ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এই উপনিবেশগুলি ফ্রান্সের অনুগত ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলনগুলি ফরাসি কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা শুরু করে। ফ্রান্স ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স।  এসময় ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মরক্কো। বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রগতি ও আধুনিকতার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে মরক্কো একটি মডেল।

নামকরণ

আরবি শব্দ মরক্কোর অর্থ ‘পশ্চিমের রাজ্য’। এই অঞ্চল আল-মাঘরেব বা ‘দূরতম পশ্চিম’ নামে পরিচিত। মরক্কো নামটি এসেছে দেশটির আগের রাজধানী মারাক্কেশ থেকে। এর অর্থ স্রষ্টার দেশ।

মরক্কো ইউরোপের খুব কাছে, অথচ ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মরক্কোতে ঐতিহ্যের পাশাপাশি প্রগতির মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে। আধুনিকতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিশেল ঘটেছে। 

মরক্কো ১৬টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলোকে ৬২টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। দেশটিতে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপ্লব। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য ইউনেসকো দেশটিকে ২০০৬ সালে পুরস্কৃত করে।

মরক্কোতে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর ফেস শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-কারাউইন ইউনিভার্সিটি। এটি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মরক্কো একমাত্র আফ্রিকান দেশ, যা আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য নয়। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশটি আরব লীগ, ওআইসি, গ্রুপ অব ৭৭ ইত্যাদি জোটের সদস্য।

উপনিবেশিক আমলের ভাষার উপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ

উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে প্রধান ভাষা আরবি। বিদেশি ভাষা হিসেবে ফরাসির স্থান প্রথমে। এরপর ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং জার্মান ভাষার স্থান রয়েছে। গত বছরগুলোতে মরক্কো এবং আলজেরিয়া উভয় দেশই তাদের সাবেক উপনিবেশিক শাসকদের ভাষার উপর নির্ভরতা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ফরাসির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা চালু করার চেষ্টা করছে দেশ দুটির সরকার। 

সূত্র : উইকিপিডিয়া,  দ্য নিউ আরব, উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম বিজয় অবলম্বনে