‘মানুষের মাঝে ভালোবাসা ছড়াও, ঘৃণা থেকে দূরে থাকো’ মাওলানা তারিক জামিলের উক্তিটি ব্যাপক জনপ্রিয়

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের এক সাধারণ তরুণ তারিক জামিল, যিনি আর ১০ জনের মতোই রঙিন স্বপ্ন বুনেছিলেন ডাক্তারি পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়বেন বলে। তবে দাওয়াতে তাবলিগের সংস্পর্শে জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এখন তিনি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও পরিচিত, দ্বীনের দায়ী মাওলানা তারিক জামিল হিসেবে। ‘মানুষের মাঝে ভালোবাসা ছড়াও, ঘৃণা থেকে দূরে থাকো’ উক্তিটি সর্বমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে তাকে।

জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা

মাওলানা তারিক জামিল ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের টুলাম্বায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মিয়া আল্লাহ বখশ ছাহু। মাওলানার পরিবার আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। তারা ছেলের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন পূরণে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল এবং লাহোর গভর্মেন্ট কলেজ থেকে প্রি মেডিকেল শেষে  এম বি বি এস সম্পন্ন করতে তারিক জামিল লাহোর কিং এডওয়ার্ড মেডিকেলে ভর্তি হন।

যেভাবে ধর্মের পথে ফিরে আসা

মাওলানা তারিক জামিলের বয়ানের মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ দ্বীনের পথে ফিরে আসছেন। অনেকের কাছেই তিনি আদর্শ-অনুকরণীয় ব্যক্তি। তবে শুরুর জীবনে একেবারে ব্যক্তিক্রম ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন লাহোর কিং এডওয়ার্ড মেডিকেলের শিক্ষার্থী। অন্য ১০ জনের মতো খেলাধুলা, আনন্দ-উৎসব, সিনেমা-মুভি দেখতেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। একজন সাধারণ মেডিকেল শিক্ষার্থী ও তার জীবনাচারে কোনও পার্থক্য ছিল না।

মেডিকেলে পড়াশোনার সময়েই পরিবর্তন আসে তার জীবনে। এসময় এক বন্ধুর মাধ্যমে তাবলিগের সংস্পর্শে আসেন তিনি৷ এরপর ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে তার জীবনে।

সিটি৪৪ ইউকে নামে এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাওলানা তারিক জামিল বলেন, ‘আমি দীনি পরিবেশে বেড়ে উঠিনি, জুনাইদ জামশেদের মতো আমিও একসময় গান গাইতাম, সিনেমা দেখতাম।’

‘আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড ছিল, যে তাবলিগ করতো। সে আমাকে এক প্রকার জোর করেই তিন দিনের জন্য তাবলিগে নিয়ে যায়। সেখান থেকেই মূলত আমার মনে হলো ডাক্তার নয়; আমাকে তাবলিগ করতে হবে। মানুষের কাছে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে। এই বোধদয়ের পর তাবলিগ থেকে ফিরেই আমি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে যাই।’

১৯৭১ সালে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে তিনি লাহোরের জামিয়া আরাবিয়া, রায়বেন্ডে পড়াশোনা করতে চান। কিন্তু তার বাবা ছেলের ডাক্তারি জীবন ছেড়ে ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধিতা করেন। একারণে তখন তিনি জামিয়া রশিদিয়া শাহীওয়ালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তার বাবা ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টি মেনে নিয়ে তাকে রায়বেন্ড মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এখানেই তিনি কুরআন,হাদিস, ফিকহ, শরিয়া,তাসাউফে বুৎপত্তি অর্জন করেন৷

সব মহলে মাওলানা তারিক জামিলের প্রভাব

এক সময় ডাক্তার হতে চাওয়া মাওলানা তারিক জামিল এখন তার পেশা জীবনের মহান ব্রত হিসেবেও বেছে নিয়েছেন ইসলামের প্রচার-প্রসারকে। একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, বক্তা। নরম স্বভাবের কারণে তার সুখ্যাতি সব জায়গায়।

পাকিস্তানে ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত তিনি। ধর্মপ্রাণ, ইসলামি অঙ্গনের মানুষের কাছে যেমন বরণীয়, ঠিক তার তেমনি প্রভাব রয়েছে পাকিস্তানের ক্রিকেটার, অভিনয় শিল্পী, সেলিব্রিটিদের মাঝে। এমনকি দেশটির রাজনৈতিক নেতারাও তার বয়ানে প্রভাবিত। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও তাকে অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাস ভবনে এক অনুষ্ঠানে মাওলানার মাধ্যমে দোয়া পরিচালনা করেন। 

পাকিস্তানের সেলিব্রেটিদের অনেকেই ধর্মের পথে ফিরে এসেছেন তার সংস্পর্শে এসে। এ তালিকায় প্রথমেই উঠে আসে এক সময়ের পপসিঙ্গার ও পরবর্তী সময়ের জনপ্রিয় ইসলামি সঙ্গীত শিল্পী জুনায়েদ জামশেদের নাম

এছাড়াও মাওলানার সংস্পর্শে ধর্মেই শান্তি খুঁজেছেন দেশটির সাবেক ক্রিকেটার সাঈদ আনওয়ার, মুহাম্মদ ইউসুফ, ইনজামামুল হক, সাকলাইন মুশতাক, সালিম মালিকসহ আরও অনেকে৷

পাকিস্তান শোবিজ জগতে অশ্লীলতাকে ব্রত করে নেয়া অভিনেত্রী ভিনা মালিকও দ্বীন-ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন মাওলানার কথায় প্রভাবিত হয়ে। পাকিস্তান শোবিজ অঙ্গনের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন মাওলানার সঙ্গে। সম্প্রতি ফিরোজখান নামে দেশটির জনপ্রিয় এক অভিনেতাও তার সংস্পর্শে শোবিজ জগত ছেড়ে ধর্মের পথে ফিরে আসার ঘোষণা দেন।

ভারতের বলিউড অভিনেতা আমির খানও মাওলানা তারিক জামিলের মাধ্যমে প্রভাবিত। ২০১২ সালে  মাওলানার সঙ্গে এক হজের সফরেও সাক্ষাত হয় আমির খানের।

মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমির খান স্বভাবতেই কিছুটা ভয়ে ছিলেন হয়তোবা তারিক জামিল তাকে শোবিজ ছেড়ে তাৎক্ষণিক দ্বীনের পথে ফিরে আসার দাওয়াত দেবেন।  কিন্তু  মাওলানা ১৯৬০-১৯৭২ সালের বলিউডের (বুম্বাই) মুভি নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। এভাবে তাদের মাঝে ভাব জমলে মাওলানা তাকে  আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হজের পদ্ধতী বিষয়ে শিক্ষা দেন।

মাওলানা তারিক জামিলের সমাজসেবা

মাওলানা তারিক জামিল মানুষের কাছে ইসলামের বাণী প্রচারের পাশাপাশি সমাজসেবা ও শিক্ষায় অবদানের অংশ হিসেবে মাওলানা তারিক জামিল ফাউন্ডেশন, জামিয়া আল হুসায়নিয়া মাদ্রাসা ও মিম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২০২১ সালে তিনি এমটিজে ব্র্যান্ড নামে একটি কাপড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এর বিক্রয়লদ্ধ অর্থ তিনি মানব সেবায় ব্যয় করেন।

ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মাওলানা তারিক জামিলের অবস্থান

২০১৩ সালে জর্ডানের রয়্যাল আল-বাইত ইনস্টিটিউট থেকে ফর ইসলামিক থট কতৃক বিশ্বের ৫০০ জন প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে একজন নির্বাচিত হন মাওলানা তারেক জামিল। এছাড়াও মাওলানা তারিক জামিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায় সবসময় শীর্ষ ৫০-এ অন্তর্ভুক্ত হন। ২০২০ ও ২০২১ সালে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি পাকিস্তানের প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার পেয়েছেন। 

নিজের বয়ানের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসারে জনপ্রিয় মার্কিন অনলাইন ভিডিও-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে  ১০ লাখ সাবস্ক্রাইবারের মাইলস্টোন পার করে ২০১৯ সালে ৩০ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ‘গোল্ডেন প্লে বাটন’ সম্মাননাও পেয়েছেন মাওলানা তারেক জামিল।