এক মসজিদে টানা ৩৫ বছর দায়িত্ব পালনের পর বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিদায় জানানো হয়েছে হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়া নামের এক ইমামকে। এ সময় এলাকাবাসীর অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তাকে পেনশন হিসেবে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে বিরল সম্মননা জানানো হয়।

১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের খুলশী কলোনি বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদে ইমাম হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়াকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়ার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরভাটা এলাকায়। তিনি মৃত হাফেজ সোলায়মানের ছেলে। 

পরিবার নিয়ে তিনি নগরের খুলশী থানার গ্রিন ভিউ আবাসিকের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। ছেলেদের সবাই কোরআনের হাফেজ। 

এলাকাবাসী, পুলিশ এবং মসজিদ কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯০ সালের দিকে হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়া মসজিদটিতে ইমামতির দায়িত্ব নেন। এরপর কেটে যায় প্রায় ৩৪ বছর। এ সময়ে তার উদ্যোগে মসজিদটিতে নানা সংস্কার হয়। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদের পাশেই আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া মদিনাতুল উলুম হেফজখানা নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়

এদিকে, গেলো বছর মহিলাদের ঈদের নামাজে অংশ নেওয়া সংক্রান্ত হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়ার দেওয়া একটি মাসআলার কারণে মসজিদ কমিটি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি এলাকার অনেকেই। 

এ নিয়ে দুই পক্ষের উত্তেজনা তৈরি হলে বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়ায়। এরপর থানায় একাধিকবার বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় ইমামকে কমপক্ষে আট মাস সময় দিতে হবে। একই সঙ্গে মানবিক কারণে তাকে মসজিদ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে পেনশনের মতো ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। 

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময় দায়িত্ব পালন শেষে গত ৩১ ডিসেম্বর বিদায় নেন ইমাম হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়া। ১ জানুয়ারি তাকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিদায় জানানো হয় এবং প্রদান করা হয় ১৫ লাখ টাকা সম্মান।

এ বিষয়ে হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৯৯০ সালে মসজিদে ইমামতি শুরু করেছি। এরপর টানা সেখানেই ইমামতি করেছি। গত ঈদে আমি মহিলাদের ঈদের নামাজে অংশ নেওয়া সংক্রান্ত একটি মাসআলা সম্পর্কে জানাই। 

‘আমি বলেছি ইসলামের প্রথম যুগে একে উৎসাহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে হযরত উমর (রা.) এবং আয়েশা (রা.) এটি নিষেধ করেছেন। এসবের দলিল হিসেব আমি সহীহ বুখারীর হাদিস উপস্থাপন করেছি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর আমাকে হঠাৎ মসজিদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এলাকার অনেকে কমিটির এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। একপর্যায়ে বিষয়টি থানায় গড়ায়। ওসি সাহেবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি ৩১ ডিসেম্বর বিদায় নিই। আমাকে কমিটি থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং ক্রেস্ট দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ওসি সাহেবের রুমে বৈঠকের পর মসজিদে আমি নামাজ পড়িয়েছি। বিদায় নেওয়ার পরও আমি ওই মসজিদে নামাজ পড়ি। বর্তমানে কমিটি কিংবা এলাকার কারও সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। সবাই আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। আমার অনেক বয়স হয়েছে। এমনিতেই অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে।

মসজিদ পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সাব্বির হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'মাওলানা কিবরিয়া আমাদের মসজিদে দীর্ঘদিন ধরে ইমামতি করেছেন। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৬২ বছর। তিনি যেন বাকি জীবন স্বচ্ছলভাবে কাটাতে পারেন এজন্য আমাদের সামান্য উদ্যোগ। আলেমরা আমাদের সমাজের মাথা। তাদের বিষয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।'

মাসআলা নিয়ে বিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত ঈদের পর কিছুটা বিরোধ হয়েছিল। থানায় একাধিক বৈঠক হয়েছে। ওসি এবং ওসি তদন্তসহ বসে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার। আমরা এসব দিয়ে ইমামকে বিদায় জানিয়েছি। আমাদের সঙ্গে তার এখন কোনো বিরোধ নেই।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোতালেব সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'একটি মাসআলা নিয়ে ইমামের সঙ্গে বিরোধ হয়েছিল। পরে ওসি সাহেব সমাধান করে দিয়েছেন। এরপর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। গত রোববার রাতে এলাকাবাসীরা তাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিয়েছেন।'

খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'খুলশী কলোনীর মসজিদে ইমাম সাহেবের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এলাকায় দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। মসজিদের কমিটির লোক ইমামকে তাৎক্ষণিকভাবে বিদায় করে দিতে চায়। স্থানীয়দের একটি পক্ষ মসজিদ কমিটির এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। পরে থানায় মৌখিক অভিযোগ এলে আমরা দুই পক্ষকে নিয়ে বসি। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় সেহেতু সিদ্ধান্ত দুই পক্ষ থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন আলেম এবং থানা থেকে একজন নিরপেক্ষ আলেম নিয়ে আবার বৈঠক হয়। বৈঠকে ইমাম সাহেবের বক্তব্য সঠিক আছে বলে বেশিরভাগই মত দেয়।'

তিনি আরও বলেন, 'তারপরও বিষয়টি নিয়ে যেহেতু ঝামেলা হয়েছে, সেজন্য ইমামকে সময় দিয়ে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে তাকে পেনশন মতো এককালীন ১৫ লাখ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকে ওই মসজিদে তিনি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইমামতি করেছেন। বিদায়ের সময় তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আমিও অংশ নিয়েছিলাম।

কমিটির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ৮ নম্বর ষোলকবহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোরশেদ আলম। আরও ছিলেন- মসজিদটির খতিব মাওলানা ড. আতাউর রহমান নদভী, খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটি মসজিদের খতিব মাওলানা হাফিজ আহমেদ। 

এনটি