যেভাবে তিনি হয়ে উঠলেন শায়খ আহমাদুল্লাহ

শায়খ আহমাদুল্লাহ— বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব। সুবিদিত ও বিদগ্ধ আলোচক। লেখালেখি, গবেষণা-আলোচনা, সভা-সেমিনারে লেকচার, নানামুখি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা, উন্মুক্ত ইসলামিক প্রোগ্রাম ও প্রশ্নোত্তরমূলক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ এবং টিভি অনুষ্ঠানে সময় দেওয়াসহ বহুমুখী সেবামূলক কাজে সপ্রতিভ গুণী ও স্বনামধন্য এই আলেমেদ্বীন।

দেশে-বিদেশে শিক্ষা, সেবা ও দাওয়াহ— ছড়িয়ে দিতে শায়খ আহমাদুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’। করোনাকালীন সময়ে ও হালে তার প্রতিষ্ঠানটি সময়োপযোগী নানা উদ্যোগ নিয়ে সর্বমহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

এর আগে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন তিনি। বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতার কারণে ডাক পান মধ্যপ্রাচ্যে। যোগ দেন সৌদি আরবের পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক দাওয়াহ সেন্টারে। দাঈ ও অনুবাদক হিসেবে সেখানে কাজ করেন দীর্ঘ ৯ বছর। সেখানে থাকাকালীন-ই আর্তমানবতার সেবায় এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে ইসলামের জ্ঞান-অভিজ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার নিজেকে সম্পৃক্ত ও নিয়োজিত রেখেছিলেন। 

বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রমে ইতোমধ্যেই তিনি জাপান, ভারত ও আরব আমিরাত সফর করেছেন এবং একাধিক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।

ইসলাম নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি লেখালেখিও করেন শায়খ আহমাদুল্লাহ। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে তার লেখা প্রকাশিত হয় প্রায় সময়। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। আরবিতেও প্রকাশিত হয়েছে তার বহু লেখাযোখা। শায়খ আহমাদুল্লাহ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ভূমিপল্লী জামে মসজিদের খতিব। পাশাপাশি সেখানকার একটি মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

কিছুদিন আগে ফেসবুক লাইভে তার সাক্ষাৎকার-জীবন্তিকা গ্রহণ করেন বিশিষ্ট আলোচক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুফতি রাফি বিন মুনিরপাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা পোস্ট। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির শ্রুতিলিখন করেছেন মাওলানা হাবিবুল্লাহ বাহার। —মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন

রাফি বিন মুনির : মুহতারাম, আপনার পড়াশোনা কোথায় কীভাবে করলেন— আমাদের খুব জানার ইচ্ছে। আপনি যদি আপনার মতো করে বলতেন...।

শায়খ আহমাদুল্লাহ : জাযাকুমুল্লাহ। আপনি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নই করেছেন। কারণ আমাদের অনেক ভাইদের জানার দরকারও আছে। আমার জন্মস্থান লক্ষ্মীপুর জেলা। জনাবওয়ালা সাহেব (রহ.)-এর নাম হয়তো শুনে থাকবেন। তাঁর বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি।

লক্ষ্মীপুরের নামকরা ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা বড়তলী মাদরাসা হয়ে আমাদেরকে বাড়ি যেতে হয়। লক্ষ্মীপুরের বশিকপুর গ্রাম— যেটিকে ওলামায়ে কেরামের গ্রাম বলা হয়। বলা হয়ে থাকে- এখানের শুধু উমেদপুর বাড়িতেই দারুল উলুম দেওবন্দপড়ুয়া অনেক আলেম ছিলেন। সংখ্যাটায় আমার মনে হয় কিছুটা অত্যুক্তি হয়। কিন্তু যখন কবরস্থানে গিয়ে মাওলানা লেখা— অসংখ্য কবর দেখি, যেগুলি আমার জন্মেরও বহু আগের; বুঝতে পারি- একসময় বহু ওলামায়ে কেরাম এখানে ছিলেন। যদিও আগের সেই ঐতিহ্য এখন একেবারেই শূন্যের কোঠায়।

আমার দ্বীনি পড়াশোনা আমার মা বাবা এবং চাচার হাতেই শুরু। যতদূর মনে পড়ে গ্রামের স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলাম। এরপর বাবা নোয়াখালী জেলার প্রধান শহর মাইজদির অদূরে হরিনারায়ণপুরে অবস্থিত দানাপুর মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। যেটি প্রতিষ্ঠা করেছেন নোয়াখালীর প্রসিদ্ধ দানামিয়া হোটেলের মালিক। সেখানে নূরানির প্রাথমিক তিন জামাতে পড়াশোনা করি। এরপর লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বোয়ালিয়া মাদরাসায় উর্দুখানা পড়ি। এরপর আমি চলে যাই হাতিয়ায়। সেখানে ফয়জুল উলুম মাদরাসায় হাতিয়ার হুজুর (রহ.)-এর কাছে সরাসরি মিজান নাহবেমির পড়ি। যিনি মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর সুযোগ্য শাগরিদ ছিলেন।

আমার এখনও মনে পড়ে হাতিয়ার হুজুর (রহ.)-এর কাছে নিয়ে যাবার পর তিনি আমার নাম রেখেছেন। আমার নাম ছিল আহমাদ হুসাইন। তিনি বদলে রেখেছেন আহমাদুল্লাহ। বললেন আমরা আহলে বাইতকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু নামের শেষে হাসান-হুসাইন ও আলি জুড়ে দেওয়া শিয়াদের পদ্ধতি— যা আমাদের দেশে চলছে। আমরা শুধুই হাসান-হুসাইন কিংবা আলি রাখবো। কিন্তু নাম রাখলেই নামের শেষে এগুলো জুড়ে দেওয়া একটা সর্বব্যাপী ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বাকর ও উমর (রা.)-এর ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা হচ্ছে না। যাই হোক, তিনি নামটা পরিবর্তন করে দিলেন।

১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় হাতিয়ায় ভয়াবহ আকারে মানুষের প্রাণহানি হয়। আমরা আলহামদুলিল্লাহ বেঁচে যাই। সেখান থেকে ফেনী হয়ে চলে যাই— হাটহাজারি মাদরাসায়। আমি সেখানে হাফেজ মুফতি শহিদুল্লাহ সাহেব (রহ.)-এর পাশের রুমে সিট পাই। যতদিন হাটহাজারীতে ছিলাম, হাফেজ শহিদুল্লাহ সাহেবের খাদেম হিসেবে ছিলাম। যারা হাটহাজারি পড়েছেন, তারা জানেন- সেখানে হুজুরদের খাদেমদের বিরাট ‘পাওয়ার’ থাকে। আমারও ছিল, আমি পিচ্ছি ছিলাম। অন্য ছাত্ররা খুব টাইট হয়ে থাকতো। তারা জানতো আমি শহিদুল্লাহ সাহেবের খাদেম। আর খাদেমরা কোনো নোটিশ করে দিলে- সমস্যা হতে পারে।

যাইহোক, সে এক মজার ইতিহাস। সেখান থেকে চলে এলাম যশোরের দড়াটানা মাদরাসায়। সেখান থেকে আমি বেফাক বোর্ডের শরহে বেকায়া বা সানুবিয়াহ (HSC) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১০ম স্ট্যান্ড করি। মিশকাতে ৩য় স্ট্যান্ড করি। দাওরায়ও (মাস্টার্স) একই মাদরাসা থেকে ২য় স্ট্যান্ড করি। আলহামদুলিল্লাহ।

মাওলানা আবদুল মালিক সাহেব হাফিযাহুল্লাহর মারকাজুদ দাওয়াহর গুণী শিক্ষক যাকারিয়্যা আবদুল্লাহ আর আমি হাটহাজারিতে একই রুমে ছিলাম। উভয়েই হাফেজ শহিদুল্লাহ সাহেবের খাদেম ছিলাম। তিনি আমার এক জামাত সিনিয়র ছিলেন। আহমাদ শফি সাহেব হুজুরের ছেলে আনাস মাদানিও যাকারিয়্যা আবদুল্লাহ ভাইদের জামাতে ছিলেন। আমরা পাশাপাশিই ছিলাম।

দাওরার বছর যশোরে যাকারিয়্যা আবদুল্লাহ ভায়ের সঙ্গে পরীক্ষা দিই। তিনি সবসময় ফাস্ট হতেন। কিন্তু সে বছর তিনি অসুস্থ ছিলেন বলে ৫ম স্ট্যান্ড করেন। আমি ২য় হই। সবশেষে খুলনা দারুল উলুম থেকে ইফতা সম্পন্ন  করি। এই হলো আমার পড়াশোনা। অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কওমি মাদরাসায়।

রাফি বিন মুনির : আলহামদুলিল্লাহ। আমরা অনেক অজানা ইতিহাস জানলাম। সবচেয়ে ভালোলাগাটা এখানে ছিল যে, মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ. হাতে গড়া আমাদের হাতিয়ার হযরত তিনি আপনার নামটা পরিবর্তন করে আহমাদুল্লাহ রেখেছেন। আর সেই নামটাই আজকে অনেক বরকতপূর্ণ নাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ কবুল করেছেন। আসলে বড়দের সবকিছু আমাদের বুঝে না আসলেও তারা আমাদের জন্য কল্যাণকর অনেক কিছু করে থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো ইতিহাস আমরা জেনেছি। শায়খ, এরপর সম্ভবত আপনি বিদেশে গিয়েছিলেন?

শায়খ আহমাদুল্লাহ : এখানে একটু বলি রাফি ভাই। আজকাল  ছাত্রদের সঙ্গে উসতাজদের তো সেরকম কোনো অন্তরঙ্গ বা রুহানি যে সম্পর্ক দরকার— তা একেবারেই নেই। আমার খুব মনে পড়ে— আমার জীবনে প্রথম যখন আমি বালেগও হইনি; বয়স বার কি তের ছুঁইছুঁই। এই বয়সে  মা-বাবাকে রেখে হাতিয়ার মতো দ্বীপ— যার চারপাশে সাগর আর সাগর ধু- ধু করছে। সি ট্রাক জাতীয় ফেরির মতো একটা বাহন তখন ছিল। এর বাইরে আর কিছু নেইও যাতায়াতের। প্রাণ নিয়ে যেতে হতো। মা-বাবাকে রেখে সেই প্রথম ঈদ করি হাতিয়া মাদরাসায়।

আমার মনে আছে উসতাজের ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা এই লেভেলের ছিল যে, আমি ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ঈদ ওখানেই কাটতো। আমি না শুধু— আমার মতো বার তের বছর বয়সের অনেক ছেলেপেলে সেই সময়ে- এখন না ছোট ছেলেপেলে দুঃসাহসী হয়- মা বাবাকে রেখে এখানে থেকে গেছি। উসতাজের স্নেহ-ভালোবাসা যে কী জিনিস— তা এখনো খুব কাজ করে। আমার মনে হয় ছাত্রবন্ধুদের উচিৎ হবে- উসতাজের সঙ্গে রুহানি একটা সম্পর্ক রাখা। বিষয়টা খুব বেশি খেয়াল রাখা চাই।

রাফি বিন মুনির : আমি যদি আপনার সঙ্গে একটু যুক্ত করি। আমাদের দেখলে অনেকে মনে করে—আমরা এভাবেই পড়াশোনা করে মানুষ হয়েছি বা এতটুকু পর্যন্ত এসেছি। আমার মনে আছে- হুজুরের কাপড় ধোয়া এরপর আয়রন করে দেওয়া বাজার করা থেকে নিয়ে— হিফজ খানার কথা বলছি- সবকিছু করতাম। তখন বুঝতামই না। আপনি যে সময়টার কথা বলছেন- ঠিক হয়তো বা বয়স দশ এগার বছর ছিল। আমাদের এ অবস্থায় আমরা এতটুকু খেদমত করেছি। আর এখনকার ছাত্ররা–আপনি যেমনটা বলছিলেন- তাদের সাহস বেশি। এ সাহসটা দেখা যাচ্ছে অনেক জায়গায় তাদের বেয়াদবে পরিণত করছে। এ কারণে ইলমের ফায়দাটা নেওয়া হচ্ছে না। এটা উচিৎ না। অবশ্যই ছাত্রদের  উসতাজের খেদমত করা দরকার। আপনি যদি এ ব্যাপারে কিছু বলতেন...

শায়খ আহমাদুল্লাহ : হ্যাঁ, বলি। আমার মনে আছে- আমি যখন হাটহাজারিতে পড়ি তখন হাফেজ শহিদুল্লাহ সাহেব (রহ.)-এর মাঝে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটা বিশেষ গুণ খুঁজে পেতাম। সেটা হলো- আজান হয়ে গেলে তিনি কাউকে আর চিনতেন না। আমরা জানি রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ কিছু হালতে আম্মাজান আয়িশা (রা.)-কেও চিনতে পারতেন না। হাদিসে আছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? বললেন, আয়িশা। বললেন, আয়িশা কে? বললেন, আবু বকরের মেয়ে। বললেন, আবু বকর কে? বললেন, আবু কুহাফার ছেলে। রাসুল কোনো কিছুই চিনতে পারছিলেন না।

তো আমার উসতাজের মধ্যে তেমনটাই খুঁজে পেয়েছিলাম। আজান হয়ে গেলে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। পাগলের মতো ছুটতেন মসজিদে। বাবরী চুল রাখতেন, তিনি এলোমেলো অবস্থায়ই ছুটতেন। গিয়ে বসতেন প্রথম কাতারে। ছাত্রদের কথা আমরা বলছি। কিন্তু আজ আমরা যারা উসতাজ রয়েছি- আমাদেরও ত্রুটির জায়গা রয়েছে। আমরা কিন্তু ছাত্রদের জন্য কাঁদি না। আমার মনে আছে, নাফহাতুল আরব হাফেজ শহিদুল্লাহ সাহেবের কাছে পড়েছি। তিনি হেদায়ার ক্লাসে কিতাবটার মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আমি একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারিনি; একটারও না।

আমার এখনও মনে আছে, তিনি তখন ছেলে মানুষের মতো কেঁদে দিলেন। হুজুর তখন স্টেজে বসে আছেন, পাশে শত শত ছাত্র। হুজুর চট্টগ্রামের ভাষায় বললেন, “বাবা, তুঁই আঁর  খেদমত গইত্যে গইত্যে পরালেখা গরিন ন পারর। এইল্লা খেদমত আঁর গরা ন পরি বো”।

হুজুর খুব রাগ হয়ে গেলেন। নিজেকে অপরাধী মনে করলেন যে, ছেলেটা আমার খেদমত করতে করতে এমন হয়েছে। আমার মনে আছে, সপ্তাহে দুই তিনবার পুরা এক বালতি কাপড় ধুতাম। রান্নাবান্না অর্থাৎ ডিম-টিম বাজি করতাম। বাসার সব কাজই করতাম। আলহামদুলিল্লাহ।

উসতাজ সে সময় ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুঁই আঁর খেদমত গরন ন পরিব, পরালেখা ভালা গরি গর।’ হজুর এ কথা বলার পর আমি চিন্তা করলাম যে, আমার এই জায়গায় ত্রুটি আছে। পড়ালেখায় আরো মনোযোগী হতে হবে। এরপর থেকে জীবনে কোনোদিন ক্লাসে সেকেন্ড হইনি।

রাফি বিন মুনির : মাশাআল্লাহ। এভাবেই আপনি আমাদের কাছে ভালোবাসার হয়ে উঠেছেন। আমাদের একজন দর্শকের মতামত আপনাকে নিয়ে “আহমাদুল্লাহ ভাইকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। উনার মাঝে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। উনার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে কারো সমালোচনা না করে কোরআন এবং হাদিস থেকে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন। জাযাকাল্লাহ খইরান”।

আমি আর কিছু বলতে চাই না। আশা করি আপনি শুনেছেন। আমরাও আপনাকে এজন্যেই ভালোবাসি। ভাই সুন্দর লিখেছেন। অনেকেই তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আচ্ছা মুহতারম, একটা বিষয় জানতে চাই তারপর সম্ভবত বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, পরে আবার কিভাবে ফিরে এলেন?

শায়খ আহমাদুল্লাহ : পরপরই আমি যাই নি। আমি পড়ালেখা করার পর কর্মজীবন শুরু হয়েছে। বেফাকে ভালো ফলাফলের সুবাধে দারুর রাশাদের বর্তমান প্রিন্সিপাল ও প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা সালমান হাফিযাহুল্লাহ আমাকে সেখানে নিযুক্ত করেন। সেখানে আরেক গল্প হচ্ছে- আমার বাবা যশোরে ব্যবসা করতেন। উনাদের গ্রামের বাড়ি নলতাতে আমরা ভাড়া থাকতাম। সেই থেকে হাতিয়া থাকতেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। সে বহু আগের কথা।

যাইহোক পরবর্তীতে আমার শরহে বেকায়া, মিশকাত ও দাওরার রেজাল্টটা যখন ভালো হয়, হুজুর অফার করলেন দারুর রাশাদে শিক্ষকতার জন্য। দারুর রাশাদে শিক্ষকতার মধ্য দিয়েই কর্মজীবন শুরু। প্রথম মিটিংয়েই আমাকে নাজেমে দারুল ইকামা বানিয়ে দেওয়া হল। আমার মুখে অল্প কটা দাড়ি গজিয়েছে মাত্র। দারুর রাশাদ সম্পর্কে আপনারা জানেন, এটা বয়স্কদের মাদরাসা। সেখানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও স্টুডেন্টরা পড়ে। এসএসসির নিচে তো কেউই নেই। আমি হলাম তাদের উসতাজই শুধু না, হোস্টেল সুপারও।

যাইহোক তিন বছর সেখানে শিক্ষকতা করলাম। এর মাঝে আমার ইমামতি হল মণিপুরে। বর্তমানে উমায়ের কোব্বাদী নামের একজন আলিমকে আপনারা অনেকেই চেনেন। উমায়ের কোব্বাদীকে আমিই দিয়ে গিয়েছি। তিন মাসের জন্য সৌদি আরবে যাওয়ার সময় উমায়ের ভাইকে দিয়ে গেলাম। পরে আমি বললাম, আমি আর আসছি না। আপনিই থাকেন। এখনও উমাইর কোব্বাদী সেই মসজিদে আছেন।

এ মসজিদে যাওয়া নিয়ে সালমান সাহেবের সাথে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। শেষে আমি ইস্তফা দিয়ে আরজাবাদে চলে আসি। আরজাবাদে রেজাউল করিম ইসলামাবাদী (রহ.) সহ বড় বড় উলামায়ে কেরামের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিসে খেদমত করার সুযোগ পাই। ইফতার ছাত্র ভাইদের সঙ্গে বসার তৌফিক হয়। মিশকাতসহ উপরের দিকের কয়েকটা ক্লাস আমাকে দেওয়া হয়। ভাংতি বছরটা সেখানে কাটানোর পর সালমান সাহেব পুনরায় আমাকে দারুর রাশাদে ডেকে নেন। দারুর রাশাদেই পুরো সময়টা থাকি। এখনও সালমান সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা রয়েছে। আমার আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মেম্বার তিনি। আমি দেখতে পেলাম আজকে লাইভ শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সালমান সাহেব ফোনও দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ তাঁর সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। লিয়াকত আলি সাহেব আমার একজন বড় মুরুব্বি তিনি ফোন দেন নিয়ম করে। তো এই ছিল দেশে কর্মজীবন।

দারুর রাশাদ খেদমতের পাশাপাশি এ সময় দারুর রাশাদে সৌদি অ্যাম্বেসি থেকে একদল মেহমান আসেন। কথার ফাঁকে আমার সাথে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি ভালো আরবি বলতে পারতাম। একবার সৌদি অ্যাম্বেসি থেকে আমাদের দাওয়াত দেওয়া হল। আমি, মাওলানা সালমান সাহেব ও মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেবসহ অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম গিয়েছিলাম। সেখানে সবচেয়ে বেশি কথা আমিই বলেছিলাম।

আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম তো আমি বেশি কথাই বলেছিলাম। বেশি কথা বলার কারণে আমি তাদের নজরে পড়ে যাই। তারা আমার নাম্বার নেন। এক বছর পর ওই ভদ্রলোক যারা সৌদি অ্যাম্বেসি থেকে এসেছিলেন, তারা আমাকে নক দিয়ে বললেন, তুমি সৌদিতে চলে আসো। আমি বললাম, কী জন্য? বললো, আমাদের এখানে ধর্মমন্ত্রণালয়ের আওতায় দাওয়াতের কাজে আসবে।

আমি আমার উসতাজদের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। তিনি বললেন, যাও। আমি ভাবলাম কিছু না হলেও অন্তত ফ্রি হজ-ওমরা হলেও তো হবে। যাই ঘুরে আসি। এই যাওয়ার পর দশ বছর থাকা সেখানে। আলহামদুলিল্লাহ, সেখানে প্রবাসী ভাইদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করার চেষ্টা করেছি। দশ বছর থাকার পর আমার মনে হলো, আসলে লাক্সারিয়াস লাইফ মিট করা- এটা তো জিন্দেগি না। আমার কাজের প্রধান ক্ষেত্র তো দেশ। প্রবাসে ভাইদের মধ্যে দ্বীনের কাজ করা যায়। কিন্তু সেখানে তো অবাধে কাজ করার সুযোগ নেই।

তখন সিদ্ধান্ত নিই যে, দেশে ফিরে আসবো। দেশে এসে কাজ করবো। ওখান থেকে বসেই একটা প্রতিষ্ঠান করার কথা চিন্তা করছিলাম। সেই চিন্তা আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়। আলহামদুলিল্লাহ, ২০১৮ শুরুর দিকে আমার আসার দশ বছর পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর বুঝলাম যে, আমার ফিরে যাওয়া উচিৎ। 

যদিও আমি সারা জীবন যদি সৌদিতে সপরিবারে কাটিয়ে দিতে চাইতাম, সেই সুযোগ হয়তো আমার ছিল। কোনো বাধা ছিল না এবং এখন যে কষ্টে আছি, সে কষ্টগুলো থাকতো না। অনেক আরামে থাকতাম। কিন্তু চলে আসলাম, কারণ আমি জানি দেশে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি। বিশেষ করে ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম; যখন দুবাইতে একটা প্রাোগ্রামে একত্রিত হই। তখন আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) আমাকে বললেন যে, ‘আমি পিএইচডি করার পর আমাকে সৌদি আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অফার করা হয়েছে। আমি দেখলাম এটা কোনো জীবন না যে আমি খুব লাক্সারিয়াস জীবন নিয়ে চললাম। কিন্তু আমি এতদূর আসলাম আমার উম্মাহর জন্য অনেক কিছু করার আছে। সেজন্য আমি চলে আসলাম।’

তো আমি আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের এ কথা দ্বারা খুব অনুপ্রাণিত হলাম। মূলত তার সে কথা থেকেই আমি মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিই যে, আমি দেশে ফিরে গিয়ে দাওয়াতি কাজ করবো। ইসলামের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। তখন পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করি। আমার স্ত্রী বললেন, আবদুল্লাহ স্যার যেটা বলেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে সঠিক ডিসিশন। বিদেশে উন্নত জীবনযাপন কোনো আলিমের লক্ষ্য হতে পারে না। এখানেও কাজ করা যায়। কিন্তু দেশে কাজের পরিধি আরো ব্যাপক। সে জায়গা থেকেই মূলত দেশে ফিরে আসা।