ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় বদর যুদ্ধ। মক্কায় কাফের-মুশরিকদের অকথ্য নির্যাতন সয়ে সাহাবিদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু কাফেররা সেই মক্কাতে বসেও মদিনায় মুসলিমদের জীবন অতিষ্ঠ করার সব পায়তারা চালিয়ে গেল। আল্লাহর নির্দেশে কাফেরদের শায়েস্তা করতে হক বাতিলের পার্থক্য স্পষ্ট লড়াই সংঘটিত হয় মদিনার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত বদর প্রান্তরে। 

এ যুদ্ধে মারা যায় কাফের শক্তির প্রধান সেনাপতি, ইসলামের ঘোরতর শত্রু আবু জাহেল। দু’জন কিশোর সহোদর ভাইয়ের হাতে নিহত হয় কাফেরদের প্রতাপশালী নেতা।

এই দুই সহোদর যখন শুনেছেন কাফেরদের সর্দার আবু জাহেল নবীকে মক্কায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। নির্মম নির্যাতনের পর নবীজি মদিনায় আসার পথেও তাকে শান্তি দেয়নি আবু জাহেলরা। তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। 

নবীকে কষ্ট দেয়ার কথা শুনে তারা শপথ করেছিলেন— আবু জাহেলকে দেখা মাত্রই হত্যা করবেন।

ঐতিহাসিক বদরযুদ্ধে আবু জাহেলও বদর প্রান্তরে এসেছে। তার ইচ্ছা, আল্লাহর নবী ও মুসলমানদের এবার শেষ করে দেবে। আবু জাহেলের রক্তে হাত রাঙানোর শপথে বলীয়ান দুই সহোদর ভাইও বদর মাঠে এলেন। চোখে আবু জাহেলকে হত্যার নেশা। মনে বহু দিনের পোষে রাখা ক্ষোভ। নাঙা তলোয়ার হাতে দাঁড়ালেন যুদ্ধমাঠে।

যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশ পক্ষের বীর উতবা, ওয়ালিদ হুঙ্কার ছেড়ে প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্বের আহ্বান জানায়। তখন মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে প্রথম আফরার তিন ছেলে মুয়াজ, মুয়াওয়িজ ও আওফ (রা.) তরবারি হাতে ময়দানের দিকে ধাবিত হন। রাসুল (সা.) তাদের বাধা দেন। হামজা (রা.), আলী (রা.) ও অন্যদের এগিয়ে দেন। প্রাণের নবীর দুশমনকে হত্যার নেশা মুয়াজ ও মুয়াওয়িজ উদ্দীপ্ত করে চলছে। তারা ছুটে চললেন। গিয়ে দাঁড়ালেন এক ব্যক্তির মাঝখানে। টার্গেট আবু জাহেল। কিন্তু আবু জাহেলকে চিনেন না। দুই তরুণের মাঝখানের সেই ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)।

আব্দুর রহমান ইবনে আউফের মুখে শোনা যাক দুই ভাইয়ের বীরত্বের কথা— ‘আমি বদর যুদ্ধের সারিতে দাঁড়িয়ে আছি। যুদ্ধ বেঁধে গেছে। আমি আমার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখি অল্প বয়স্ক দু’জন আনসার যুবকের মাঝে আমি রয়েছি। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাদের অপেক্ষা শক্তিশালীদের মধ্যে থাকি। তখন তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, চাচা! আপনি কি আবু জাহেলকে চিনেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ। তবে ভাতিজা, তাকে তোমার কি প্রয়োজন?

সে বলল, আমি জানতে পেরেছি, সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে গালমন্দ করেছে। আমি আল্লাহর সঙ্গে চুক্তি করে এসেছি— যার হাতে আমার প্রাণ। আমি তার ওপর আক্রমণ করব এবং আক্রমণ চালিয়েই যাব যতক্ষণ আমাদের মধ্যে কেউ একজন না মরবে। যার মরণ আগে নির্ধারিত সেই মরবে। আমি হই বা সে...।

আমার হূদয় সাহসে ভরে গেল। আমি তার কথায় বিস্মিত হলাম। তা শুনে দ্বিতীয়জন আমাকে অনুরূপ বলল। তৎক্ষণাৎ আমি আবু জাহেলকে দেখলাম। সে মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন আমি বললাম, এই যে তোমাদের সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে। তারা তৎক্ষণাৎ নিজের তরবারি নিয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে হত্যা করল। এরা হলো, আফরার দুই পুত্র।’ (বুখারি: ৩৯৮৮)

মুয়াজের বর্ণনায় আবু জাহেল হত্যার চিত্রপট এভাবে বর্ণিত হয়েছে— ‘আমি যখন আবু জাহেলকে চিনে নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্দেশ্য করে রওনা করলাম। মুশরিকরা তার নিরাপত্তার জন্য চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। একজন মুসলিম সৈনিক আমাকে লক্ষ করে বললেন, ওহে বালক, আবু জাহেলের কাছে যেও না। তোমার ওপর কঠিন বিপদ নেমে আসবে। আল্লাহর কসম, তার সাবধান বাণী শুনে আমার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। তাকে হত্যার দৃঢ়তা বৃদ্ধি পেল।

আমি আবু জাহেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। সুযোগ পেয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ক্ষিপ্র বেগে আঘাত করলাম। প্রচণ্ড গতির আঘাতে তার পায়ের গোছা শরীর থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে থুবড়ে পড়ল। আমার ভাই মুয়াউওয়াজও আমার অনুসরণ করল।

সে আবু জাহেলের ওপর চড়ে বসে তার গলায় ছুরি চালাতে থাকল। মুশরিকরা আবু জাহেলকে বাঁচানোর জন্য তার দিকে তীর, বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। চতুর্মুখী আক্রমণে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। তিনি শহিদ হয়ে আবু জাহেলের পাশেই পড়ে রইলেন। আবু জাহেলের পুত্র ইকরামা আমার কাঁধের ওপর তরবারির আঘাত চালাল, আমার বাম হাত কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার উপক্রম হলো। কিন্তু হাতটি বাম পাঁজরের চামড়ার সঙ্গে ঝুলে থাকল।’

যুদ্ধ থেমে গেল। মুশরিকরা পালানোর পথ ধরল। ৭০ মুশরিক বন্দি হলো। ৭০ জন মারা পড়ল। মুসলমানদেরও ১৪ জন শহিদ হয়ে জান্নাতে পৌঁছে গেল। রাসুল (সা.)-এর কাছে আবু জাহেলের মৃত্যু সংবাদ আসে। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। প্রীত হলেন। দুই বালকের শপথে বলীয়ান ও সাহসের গল্প শুনলেন। আল্লাহর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের আকুণ্ঠ সমর্পণ দেখে তিনি বেজায় খুশি হলেন। তাদের জন্য দোয়া করলেন। কাছে ডাকলেন।

আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাদের কাজে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘ওই দুই ভাইয়ের মধ্যে অবস্থান করে আমি যে আনন্দ পেয়েছি, তা আর কোনো দু’জনের মধ্যে অবস্থান করে পাইনি, রাসুলের কথা আলাদা।’

ইতিহাসের নিকৃষ্ট চরিত্র আবু জাহেলের হত্যাকারী দুই মুসলিম তরুণের মা আফরা বিনতে উবাইদ (রা.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে বিরলতম উদাহরণ। এ মহীয়াসী নারীর সাত সন্তানই বদরযুদ্ধে অশংগ্রহণ করেছিলেন।