মা শব্দটি অতি ছোট হলেও এর সঙ্গে মিশে আছে মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা। সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ ও দুঃখ-কষ্ট বর্ণনাতীত। কোরআনুল কারিমে কয়েকজন নবী ও রাসুলের মায়ের বর্ণনা এসেছে। এসব ঘটনা থেকে আল্লাহর জন্য নিজের সর্বোচ্চটুকু সোপর্দ করা এবং সন্তানদের মধ্যে আল্লাহর বিশ্বাস ও নির্ভরতা তৈরির শিক্ষা লাভ করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

ইসমাঈল (আ.)-এর মা

মহান আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) তাঁর শিশুসন্তান ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা হাজেরা (আ.)-কে মক্কার মরু প্রান্তরে রেখে আসেন। তখন তিনি তাঁদের জন্য মন খুলে দোয়া করেন।

ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার রব, আমি আমার বংশধরদের অনেককে অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের কাছে বসবাস করিয়েছি, হে আমার রব! তা এই জন্য যেন তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, অতএব আপনি কিছু মানুষের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করুন এবং নানা রকম ফল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞ হয়। ...সব প্রশংসা মহান আল্লহর জন্য, যিনি আমাকে বার্ধক্যে ইসমাইল ও ইসহাককে দান করেছেন, আমার রব অবশ্যই দোয়া শোনেন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৭-৩৯)

মুসা (আ.)-এর মা

পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.)-এর বর্ণনা সবচয়ে বেশি এসেছে। বিশেষত তার মায়ের আত্মত্যাগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসা (আ.) জন্মগ্রহণের পর তার মায়ের মনে ফেরাউনের সৈন্যদের ব্যাপারে ভয় কাজ করে। তখন মহান আল্লাহ নবজাতক সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাহ্যিকভাবে তা একজন মায়ের জন্য খুবই পীড়াদায়ক হলেও এর মাধ্যমে সেই শিশু ফেরাউনের প্রাসাদে নতুন জীবন লাভ করে এবং পরবর্তীতে নবী হয়ে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করতে শুরু করে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘মুসার মায়ের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিই যে সে যেন শিশুকে স্তন্যদান করেন, অতঃপর যখন তার ব্যাপারে কোনো আশঙ্কা করবে তখন তাকে সাগরে নিক্ষেপ কোরো, এবং ভয় কোরো না ও দুঃখ কোরো না, আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসুলদের একজন করব। অতঃপর ফেরাউনের পরিবার তাকে তুলে নেয়, পরবর্তী সময়ে সে তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়; ফেরাউন, হামান ও তাদের বাহিনী ছিল অপরাধী। ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এই শিশু আমার ও তোমার চোখ শীতল করবে, তাকে হত্যা কোরো না, সে আমাদের উপকারে আসতে পারে, আমরা তাকে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি, আসলে তারা এর পরিণাম বুঝতে পারেনি। মুসার মায়ের অন্তর অস্থির হয়ে পড়েছিল, যাতে সে আস্থাশীল হয় সে জন্য আমি তার অন্তরকে দৃঢ় না করি, নতুবা সে তার পরিচয় প্রকাশ করে দিত। সে মুসার বোনকে বলল, তার পেছনে পেছনে যাও, সে তাদের অজ্ঞাতসারে দূর থেকে তাকে দেখছিল। আগে থেকেই আমি ধাত্রীদের স্তন্যপান থেকে তাকে বিরত রেখেছিলাম। মুসার বোন বলল, তোমাদেরকে কি আমি এমন পরিবারের সন্ধান দেব যে তোমাদের হয়ে তার লালন-পালন করবে এবং তারা হবে তার হিতাকাঙ্ক্ষী।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭-১২)

ইয়াহইয়া (আ.)-এর মা

জাকারিয়া (আ.)-এর কোনো সন্তান ছিল না। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা ও বয়স্কা। তবে আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি তাঁরা হতাশ ছিলেন না। তাঁরা গোপনে আল্লাহর কাছে সুসন্তানের জন্য দোয়া করতেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘জাকারিয়া মহান রবকে ডাকতে শুরু করে, হে আমার রব, আমাকে একাকী ছেড়ে দেবেন না, আপনি সর্বোত্তম উত্তরাধিকারক। আমি তার ডাকে সাড়া দিই, ইয়াহইয়া নামে একজন সন্তান দিই এবং তার স্ত্রীকে উপযুক্ত করে তুলি, তারা কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী ছিল, আমাকে তারা আগ্রহ ও ভয়ে ডাকত, আসলেই তারা আমার প্রতি অনুগত ছিল।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৯-৯০)

মারইয়াম (আ.)-এর মা

ইমরান (আ.)-এর স্ত্রী হাননাহ ছিলেন একজন আল্লাহভীরু নারী। অনেক দোয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হয়। তখন তাঁর স্ত্রী গর্ভের সন্তানকে আল্লাহর জন্য মানত করেন। 

কোরআনে এসেছে, ‘স্মরণ করুন, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার রব, আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তা একান্ত আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম, আপনি তা আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন, আপনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। অতঃপর যখন তিনি প্রসব করলেন তখন বললেন, হে আমার রব, আমি তো কন্যা প্রসব করেছি, সে যা প্রসব করেছে আল্লাহ তা সম্পর্কে অবগত, আর ছেলে তো এই মেয়ের মতো নয়, আমি তার নাম মারইয়াম রাখি, এবং অভিশপ্ত শয়তান থেকে তাকে ও তার বংশধরের জন্য আপনার আশ্রয় চাচ্ছি। তার রব তাকে উত্তমভাবে কবুল করেন, তাকে উত্তমভাবে লালন-পালন করেন, তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন, যখনই মারইয়ামকে জাকারিয়া দেখতে আসতেন তাঁর কাছে খাদ্যসামগ্রী দেখতেন, তখন তিনি বলতেন, হে মারইয়াম, তোমার কাছে এগুলো কোত্থেকে? মারইয়াম বলতেন, তা আল্লাহর কাছ থেকে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অগণিত রিজিক দেন।’ (সুরা : আলে-ইমরান, আয়াত : ৩৫-৪১)

ঈসা (আ.)-এর মা

কোরআনে এসেছে, ‘আপনি কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করুন, যখন সে পরিবার থেকে পৃথক হয়ে পূর্ব দিকের এক স্থানে আশ্রয় নেয়। অতঃপর তাদের থেকে সে পর্দা করল, আমি তার কাছে আমার পক্ষ থেকে জিবরাইলকে পাঠাই, সে তার কাছে মানুষের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করে। মারইয়াম বলল, আল্লাহকে ভয় কোরো যদি তুমি মুত্তাকি হয়ে থাকো, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় চাই। সে বলল, আমি তো তোমার রবের পক্ষ থেকে এসেছি, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করতে। 

মারইয়াম বলল, আমার পুত্র হবে কিভাবে; আমাকে তো কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারী নারীও নই? সে বলল, এমনই হবে, তোমার রব বলেছেন, তা আমার জন্য সহজ এবং আমি তাকে সৃষ্টি করব যেন সে মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে এক অনুগ্রহ হয়; তা তো স্থিরকৃত বিষয়। সে তাকে গর্ভে ধারণ করে, অতঃপর তাকে নিয়ে দূরবর্তী স্থানে চলে যায়। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুরগাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে, সে বলল, হায়, আমি যদি এর আগেই মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হতাম। নিচ থেকে এক ফেরেশতা তাকে ডেকে বলল, তুমি দুঃখ কোরো না, তোমার রব তোমার পাদদেশে একটি নদী তৈরি করেছেন। তুমি তোমার কাছের খেজুরগাছের ডাল নাড়া দাও, তা তোমাকে পাকা তাজা খেজুর দেবে। অতএব আহার করো, পান করো, চোখ জুড়াও, কোনো মানুষ দেখলে বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশে চুপ থাকার মানত করেছি, সুতরাং আজ আমি কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ১৬-২৬)

আল্লাহ আমাদেরকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করুন। আমিন।