প্রতীকী ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ। ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। স্বাস্থ্যসেবা কোনো দাবি নয়, বরং সবার অধিকার— এ অধিকার বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৭ এপ্রিলকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

প্রসঙ্গত, সুস্থতা প্রত্যেক মানুষের কাম্য। সুস্থ ও নিরাপদ থাকতে চায় না— এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুস্থতা-অসুস্থতায় ভিত্তি করে মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্মপরিধি নির্ধারিত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুর্বল মুমিনের তুলনায় সবল মুমিন অধিক কল্যাণকর এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। আর যা তোমাকে উপকৃত করবে, সেটিই কামনা করো।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৪)

ইবাদতের জন্য শক্তি-সামর্থ্য
আমল-ইবাদতের জন্য কায়িক ও শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োজন। শারীরিক শক্তি ও কায়িক সামর্থ্য আল্লাহ তাআলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর আগে এগুলোর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। এর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা।

তিনি বলেন— 

পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার আগে গনিমতের অমূল্য সম্পদ হিসেবে মূল্যায়ন করো। জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার আগে। অবসর সময়কে ব্যস্ততা আসার আগে। যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে এবং সচ্ছলতাকে দরিদ্রতা আসার আগে।

মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ৮/১২৭; সহিহুল জামে, হাদিস : ১০৭৭

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ
ইসলামে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা সম্পর্কে রয়েছে বিশদ আলোচনা। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সতর্কতা সত্ত্বেও কোনো রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে গেলে এর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রতিও রয়েছে জোরালো তাগিদ।

ইসলাম রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বারোপ করেছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করেছে। এজন্য আমরা দেখতে পাই, যে বিষয়গুলোর কারণে মানুষের রোগ হয় ইসলাম আগেই সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইসলামে হালাল-হারাম খাবারের বিবরণ দেখলে তা সহজেই অনুমেয়। ওয়াহাব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭০৩; তিরমিজি, হাদিস : ২৩৫০)

স্বাস্থ্য রক্ষায় ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। শরীরের যথেচ্ছ ব্যবহার উচিত নয়। কোরআন-সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেমন গুরুত্ব দিয়েছে, তেমনি তা কার্যকরের ফলপ্রসূ উপায় বাতলে দিয়েছে। যেমন- নেশাজাতীয় দ্রব্য হারাম করা এবং পরিমিত আহার ও সময়ানুগ খাবার গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া। কাজেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়া মুসলমানদের ঈমান ও বিশ্বাসের দাবি।

দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া
কোনো কারণে মানুষ অসুস্থ হলে আল্লাহ তাকে তার অসুস্থতার কারণে সওয়াব ও পুণ্য দান করেন। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে অসুস্থ হলে অবশ্যই তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সুস্থ থাকাকে ইসলাম অধিক উৎসাহিত করেছে।

নবী করিম (সা.) তার সাহাবিদের দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি নিজে অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন— 

পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি স্বভাব
সুস্থ দেহ ও মনের জন্য পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি গুণ আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন। অপরিচ্ছন্নতা ও এলোমেলো পরিবেশ রোগব্যাধি ছড়ায়। আর ধীরে ধীরে এর প্রভাব মন ও মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই মহানবী (সা.) এ বিষয়ে বিশেষ সতর্ক করেছেন।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচটি বিষয় মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি ১. খতনা করা, ২. নাভির নিচের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা, ৩. গোঁফ কাটা, ৪. নখ কাটা, ৫. বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৮৮৯)

এছাড়াও পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে প্রচুর হাদিস বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য রক্ষায় হাঁটাহাঁটি
হাঁটাহাঁটি শরীরচর্চার অনবদ্য মাধ্যম। মহানবী (সা.) দ্রুত হাঁটতেন। আবার কখনো কখনো দৌড় প্রতিযোগিতাও করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজির চেয়ে দ্রুতগতিতে কাউকে হাঁটতে দেখিনি।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬৪৮)

সুস্থ দেহের জন্য মানসিক প্রফুল্লতারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রাসুল (সা.) নিজেও অত্যন্ত সদালাপী ও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, আমরা হুজুর (সা.)-এর চেয়ে হাসিখুশি আর কাউকে দেখিনি। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬৪১)

নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস
পরিমিত বা নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস সুস্থ দেহের জন্য একান্ত অপরিহার্য। স্বল্প আহার ও অতিভোজন দুটিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ খাদ্যাভ্যাস আমাদের অনুসরণীয় হতে পারে। যেমন তিনি খুব পরিমিত আহার করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫০৮১)

খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি পেটের এক ভাগ খাদ্য, এক ভাগ পানীয়, আর এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ফাঁকা রাখতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৮১) আর স্বাস্থ্যকর আহার গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৪৩১)

সকালের ঘুমকে না বলুন
সকালের ঘুম সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ব্যক্তিজীবন গঠনে বড় প্রতিবন্ধক। পবিত্র কোরআনে অনেকাংশে সূর্যোদয় ও অস্তের সময় আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতে বলা হয়েছে। এজন্য রাতের শুরুর অংশেই বিছানায় যাওয়ার বিকল্প নেই। চিকিৎসাশাস্ত্র মতেও রাত্রি জাগরণ নানাবিধ জটিল রোগের উৎস।

ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন— 

একদা রাসুল (সা.) আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং বললেন, ‘মা মণি! ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কেননা আল্লাহ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রিজিক বণ্টন করে থাকেন।

আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ২৬১৬

কাজেই স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতা, শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং রোগবালাই হলে চিকিৎসা নেওয় মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ মুমিন পার্থিব-অপার্থিব প্রতিটি কর্মের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন। আর তার পক্ষ থেকে পুণ্য ও সওয়াব লাভে ধন্য হন।