বনী ইসরাঈল যে কারণে ৪০ বছর দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরেছিল
প্রতীকী ছবি
বনী ইসরাঈলের অন্যতম প্রধান নবী ছিলেন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম। মুসা আলাইহিস সালামের জাতির ওপর দীর্ঘদিন অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিলো ফেরাউন। ফেরাউনের কবল থেকে বনী ইসরাঈলের মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা মুসা আলাইহিস সালামকে তার জাতিকে নিয়ে মিসরে ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এসময় তাদেরকে পবিত্র ভূমি শামে বসবাসের সুংবাদ দেওয়া হয়। এই ভূমির অধিকার গ্রহণের জন্য তাদের তৎকালীন আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার নিদের্শ দেওয়া হয়। যুদ্ধে বনী ইসরাঈলই জয়ী হবে এ সুসংবাদও দেওয়া হয়।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
বিজ্ঞাপন
یٰقَوۡمِ ادۡخُلُوا الۡاَرۡضَ الۡمُقَدَّسَۃَ الَّتِیۡ کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَرۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ یقوم ادخلوا الارض المقدسۃ التی کتب الله لکم و لا ترتدوا علی ادبارکم فتنقلبوا خسرین
‘হে আমার কওম, তোমরা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন এবং তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যেয়ো না, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে’। (সূরা মায়েদা, (৫), আয়াত, ২১)
বিজ্ঞাপন
তবে পবিত্র এই ভূমিতে বনী ইসরাঈলের বসবাসের জন্য আমালেকা সম্প্রদায়কে এখান থেকে সরানো জরুরি ছিল। এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের সঙ্গে জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ দেন মূসা আলাইহিস সালাম ও বনী ইসরাঈলকে।
কিন্তু বনী ইসরাঈলের স্বভাবে সবসময় ঔদ্ধত্য ও বক্রতা ছিল। তারা আল্লাহর আদেশ পালন করতে রাজি হলো না। যুদ্ধে বিজয়ের সুসংবাদ পাওয়ার পরও তারা আমালেকা সম্প্রদায়ের প্রচলিত বীরত্ব-প্রসিদ্ধির কারণে ভীতু হয়ে পড়ে, প্রথম ধাপেই শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলে। এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তারা মূসা আলাইহিস সালামকে বলল, হে মূসা! এ দেশে প্রবল পরাক্রান্ত জাতি বাস করে। যতদিন এ দেশ তাদের দখলে থাকবে, ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। যদি তারা অন্য কোথাও চলে যায়, তবে আমরা সেখানে যেতে পারি।
পুরো বনী ইসরাঈলে শুধু দুইজন ব্যক্তি ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার ছিলেন, আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাদের অন্তরে। তারা মূসা আলাইহিস সালামের আদেশ মানতে রাজি হলেন। এর পাশাপাশি তারা নিজ সম্প্রদায়কে বোঝাতে লাগলেন যে, তোমরা সাহস তো কর। তারপর দেখ, কেমন করে আল্লাহ তোমাদেরকে (ওই শত্রুদের ওপর) বিজয় দান করেন।
তারা নিজের নবীর মুখে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয়ের সুসংবাদ শুনেও তা অস্বীকার করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে নিজ সম্প্রদায়ের লোকের উপদেশ তাদের কাছে কোনো গুরুত্ববহন করেনি।
আরও পড়ুন
এ সময় তারা কাপুরুষতা, বেআদবী, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের চরমে চলে গেল। বিদ্রূপের ভঙ্গিতে মূসা আলাইহিস সালামকে বলল যে, ‘তুমি ও তোমার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসলাম!’ তাদের এই বিদ্রুপ ও অবাধ্যতার কথা আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কোরআনে তুলে ধরেছেন। বর্ণিত হয়েছে,
قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ فِیۡهَا قَوۡمًا جَبَّارِیۡنَ ٭ۖ وَ اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَا حَتّٰی یَخۡرُجُوۡا مِنۡهَا ۚ فَاِنۡ یَّخۡرُجُوۡا مِنۡهَا فَاِنَّا دٰخِلُوۡنَ قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِیۡنَ یَخَافُوۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمَا ادۡخُلُوۡا عَلَیۡهِمُ الۡبَابَ ۚ فَاِذَا دَخَلۡتُمُوۡهُ فَاِنَّکُمۡ غٰلِبُوۡنَ ۬ۚ وَ عَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَاۤ اَبَدًا مَّا دَامُوۡا فِیۡهَا فَاذۡهَبۡ اَنۡتَ وَ رَبُّکَ فَقَاتِلَاۤ اِنَّا هٰهُنَا قٰعِدُوۡنَ
অর্থাৎ, তারা বলল, ‘হে মূসা, নিশ্চয় সেখানে রয়েছে এক শক্তিশালী জাতি এবং আমরা নিশ্চয় সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে বের হয়। অতঃপর যদি তারা সেখান থেকে বের হয়, তবে নিশ্চয় আমরা প্রবেশ করব’।
যারা (আল্লাহকে) ভয় করছিল তাদের মধ্যে দু’জন লোক যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন বলল, তাদের দরজায় হানা দাও, ঢুকলেই তোমরা জয়ী হয়ে যাবে। তোমরা মু’মিন হলে আল্লাহর উপর ভরসা কর।
তারা বলল,
‘হে মূসা তারা যতক্ষণ সেখানে থাকবে ততক্ষণ আমরা সেখানে কখনো প্রবেশ করব না; কাজেই তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর। নিশ্চয় আমরা এখানেই বসে থাকব।’
(সূরা মায়েদা, (৫), আয়াত, ২২-২৪)
মুসা আলাইহিস সালাম যখন নিজের সম্প্রদায়কে (ইহুদি জাতি/ বনী ইসরাঈল) কোনোভাবে বোঝাতে পারলেন না, তার নিজেদের অবাধ্যতা ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে বিদ্রোহ থেকে কোনোভাবে ফিরে আসলো না, তখন তিনি নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতা প্রকাশ করলেন এবং তাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করলেন।
এর পরিণতি হিসেবে মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন। তাদেরকে ৪০ বছর পর্যন্ত একটি সীমাবদ্ধ এলাকায় অবরুদ্ধ ও বন্দি রাখেন। বাহ্যত তাদের চারপাশে কোনো বাধার প্রাচীর ছিল না এবং তাদের হাত-পা শিকলে বাধা ছিল না; বরং তারা ছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাদের সেই শাস্তির বর্ণনাও স্পষ্টভাবে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তিনি (মুসা) বলেন, ‘হে আমার রব, আমি ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো ওপর আমার অধিকার নেই। সুতরাং আপনি আমাদের ও অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিন। তিনি (আল্লাহ) বলেন, যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল যে তারা ৪০ বছর যাবৎ দিন-রাত সকাল-সন্ধ্যা তিহ ময়দানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভবঘুরে জীবন যাপন করবে।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ২৫-২৬)
তারা স্বদেশে অর্থাৎ মিসর ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথও চলত; কিন্তু তারা নিজেদের সেখানেই দেখতে পেত, যেখান থেকে সকালে রওনা হয়েছিল। এর মধ্যে হজরত মুসা ও হারুন আলাইহিমুস সালামের মৃত্যু হয়ে যায় এবং বনী ইসরাঈল তিহ প্রান্তরেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের হিদায়াতের জন্য অন্য একজন নবী প্রেরণ করলেন। ৪০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বনী ইসরাঈলের অবশিষ্ট বংশধর তৎকালীন নবীর নেতৃত্বে শাম দেশের সে এলাকা তথা সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য জিহাদের সংকল্প গ্রহণ করে এবং আল্লাহ তায়ালার ওয়াদাও পূর্ণতা লাভ করে। (ইবন কাসির)
এনটি