মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান। ছবি : সংগৃহীত

প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান আর নেই। বুধবার (২১ এপ্রিল) নয়াদিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

তার মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বের অপূরণীয় এক ক্ষতি হলো। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। ইসলামি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শন, জীবন ও জগৎ প্রগাঢ়ভাবে মন্থিত করে সুবর্ণ আহরণের ক্ষেত্রে তিনি ইবনে খালদুনের পর অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব বলে অনেকে মনে করেন। যুদ্ধ নয় বরং শান্তি, হিংসা নয় বরং প্রেম, দ্বেষ নয় বরং মায়া এবং পরোপকারিতাই হলো জাতি ও ব্যক্তি জীবনে শিখরে ওঠার সোপান— সে কথাই মাওলানার সৃষ্ট সাহিত্যে অনুরণিত হয়েছে ক্ষণে-ক্ষণে ও বারংবার।

ইসলাম সন্ত্রাস নয়, শান্তির ধর্ম- এ বিষয়টিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন শতধাধারায়। বিক্ষুব্ধ বিশ্বে শান্তির পায়রা উড়াতে তিনি প্রয়াস পেয়েছেন অক্লান্ত মেহনতে ও বর্ণনাতীত পরিশ্রমে। স্বীকৃতিও পেয়েছেন নিশ্চয়। ডেমিয়ারগাস আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার, রাজীব গান্ধী সাধভাবন পুরস্কার, পদ্মভূষণ পুরস্কার, ন্যাশনাল সিটিজেন পুরস্কার, ন্যাশনাল ইন্টেগ্রেশন অ্যাওয়ার্ড, কমিউন্যাল হারমনি অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল অ্যামিটি অ্যাওয়ার্ড, আবুধাবী থেকে তিনি ইমাম হাসান ইবনে আলি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার এবং ভারতের সর্বোচ্চ  দ্বিতীয় বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্ম ভিবুশন এ্যাওয়ার্ড পান। উত্তর আমেরিকার সর্বপরিচিত ইসলামি সংস্থা ISNA তাকে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভম্যান্ট’ দিয়ে সম্মানিত করে।

শুধু তাই নয় বরং আমেরিকার জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত The 500 Most Influential Muslims of 2009 গ্রন্থে তাকে ‘বিশ্বের প্রতি ইসলামের আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি’ (Islam’s Spiritual Ambassador to the World) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান ভারতের আজমগড়ে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গতানুগতিক কওমি মাদরাসা ‘মাদরাসাতুল ইসলাহ’ থেকে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর আধুনিক যুগের ভাব ও বোধের নিগুঢ়তা স্পর্শের জন্য দীর্ঘ বিশ বছর ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পেছনে মেহনত করে যান। লাইব্রেরিতে পড়ে থাকেন দিনের পর দিন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের ক্ল্যাসিকাল জ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সিদ্ধতা অর্জনে সবাইকে তিনি ছাড়িয়ে যান। দীর্ঘ গবেষণা ও অধ্যয়নের পর তিনি যে সিদ্ধান্তে আসেন তা হলো- বিজ্ঞানোত্তর যুগের স্টাইল ও ভাষায় ইসলামি চিন্তার নির্মাণ নিশ্চিত করতে না পারলে আধুনিক মানসে ইসলামের প্রেমসৃজন কখনোই সম্ভবপর হবে না।

দীর্ঘ অধ্যয়নের ফলাফল তিনি প্রকাশ করতে শুরু করেন ১৯৫৫ সাল থেকে। ‘নায়ে আহাদ কি দারওয়াজা পর’ (নবযুগের দরোজায়) হলো তার প্রথম গ্রন্থ যা প্রকাশ করে তিনি পাঠকমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলো তিনি তার দ্বিতীয়গ্রন্থ ‘ইলমে জাদিদ কা চ্যালেঞ্জ’ (আধুনিক বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ)-এ তুলে ধরেন বিশিষ্ট আকারে এবং চমকে দেন সবাইকে।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রগাঢ় অন্তরঙ্গতায় বইটি হয়ে ওঠে এতই অভূতপূর্ব যে, আরববিশ্বে এর আরবি অনুবাদ আল-ইসলামু ইয়াতাহাদ্দা প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। এমনকি মিসরের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ড. আবদুস সাবুর শাহিন বলেই ফেললেন, ‘বিগত কয়েক শতাব্দীতে কোনো মুসলমান কর্তৃক লিখিত হাতেগোণা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসগুলোর মধ্যে আল ইসলামু ইয়াতাহাদ্দা অন্যতম।’ পরবর্তীতে বইটি সদর্পে জায়গা করে নেয় আরববিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে।

মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান ১৯৭০ সালে নয়া দিল্লিতে গবেষণাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, নাম দেন ‘ইসলামিক সেন্টার’। ১৯৭৬ সালে তিনি উক্ত সেন্টার থেকে উর্দু ভাষায় মাসিক আল-রিসালা সাময়িকী প্রকাশ করেন। ১৯৮৪ সালে এর ইংরেজি ও ১৯৯০ সালে হিন্দি সংস্করণ বের করেন।  তিনি আল-কোরআনের তাফসির ও মহানবী (সা.)-এর সিরাতসহ দু্ইশ’রও বেশি যুগান্তকারী গ্রন্থ রচনা করেন। যার মধ্যে অন্যতম হল, Tazkeerul Quran; Prophetic Wisdom; Spirituality and Peaceful Co-existence in a Multi-ethnic Society; The Prophet of Peace; The Teachings of Prophet Muhammad; Jihad, Peace and Inter-Community Relations in Islam; Woman between Islam and Western Civilization; God Arises. ইত্যাদি।

গত ১২ এপ্রিল কোভিড-১৯ টেস্ট পজিটিভ আসায় মাওলানাকে  দিল্লির এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২১ এপ্রিল তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে এবং আনুমানিক রাত ৯:৪৫- এ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা তার সকল খেদমত কবুল করুন। তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত করুন। আমিন।