ছবি : সংগৃহীত

জাকাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের ধন-সম্পদে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে। দারিদ্র্য মোচন করে ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে জাকাত। ঈমানের পর নামাজ ও তার পরই জাকাতের স্থান। কোরআন মজিদের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা তার অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, ‘আর তারা যা কিছু দান করে এভাবে দান করে যে, তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে (একথা ভেবে) যে, তারা তাদের রবের নিকটে ফিরে যাবে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৬০

এক আয়াতে মুমিনদের সম্বোধন করে বলেন, ‘... এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭২)

অন্য এক আয়াতে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে, তারা যেন অসংযত আচরণের মাধ্যমে তাদের দান-সদকাকে ব্যর্থ না করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না। ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর।’ (সুরা বাকারা, হাদিস : ২৬৪)

কোরআন মজিদের উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত  হয় যে, বিনয়, খোদাভীতি, ইখলাস-নিষ্ঠা ও উত্তম চরিত্র হলো— দান-সদকা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো জাকাত আদায় করে দেওয়া কর্তব্য।

যেভাবে জাকাত দিতে হয়

এক.
বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর জাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে— তোমাদের কারও মৃত্যু আসার পূর্বে। অন্যথায় মৃত্যু এলে সে বলবে— হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদাকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মুনাফিকুন, আয়াত : ১০)

এক্ষেত্রে করণীয় হল, নিসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়েই জাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।

দুই.
যে দিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই জাকাত আদায় করা ফরজ হয়। এরপর যখনই জাকাত আদায় করুক সে পরিমাণই আদায় করতে  হবে যা সেই দিন ফরজ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস : ১০৫৫৯)

তিন.
বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌরবর্ষের নয়।

জাকাত আদায়ে নিয়ত করা
জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)

চার.
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই জাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে জাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৪)

জাকাতের উপযুক্ত খাতে— যেমন ফকির-মিসকিনকে দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে জাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে, পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকির-মিসকিনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার, আয়াত : ২/২৬৮)

পাঁচ.
জাকাতের উদ্দেশ্যে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে জাকাত আদায়ের সময় জাকাতের নিয়ত করতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩৯১, ১০৩৯২)

ছয়.
জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে, কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে জাকাতের নিয়ত ছিল না— তো গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জাকাতের নিয়ত করলে— জাকাত আদায় হবে। তদ্রূপ জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হলে— গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেওয়ার আগে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। এরপরে জাকাতের নিয়ত করলে— জাকাত হিসেবে আদায় হবে না। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৮; রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮-২৬৯)

সাত.
জাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফকির-মিসকিনকে দেওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল— তাহলে জাকাত আদায় হব না। পুনরায় জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৬৯৩৬-৬৯৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৫৩১-৫৩২; রদ্দুল মুহতার : ২/২৭০)

আট.
যে সম্পদের উপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৫৭০-১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮০৩; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১৩৩-৭১৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৫৩৯-১০৫৮১)

নয়.
যে পরিমাণ জাকাত ফরজ হয় স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলেও অসুবিধা নেই। এতে জাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দু’টোরই ছওয়াব পাওয়া যাবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৬৯০৭)

দশ.
জাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে জাকাত দেওয়া হচ্ছে। যেকোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে জাকাতের মাল দেওয়া হলে— মালিক যদি মনে মনে জাকাতের নিয়ত করে, তাহলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮)

এগারো.
অন্যের পক্ষ থেকে জাকাত আদায় করতে হলে— তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৯)

বারো.
গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদেরকে জাকাত দেওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন, তাহলে তারা জাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে— তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। আর যদি আগে অনুমতি দেওয়া না থাকে, আর ঘরের লোকেরা জাকাত হিসেবে কিছু দান করে; তাহলে যাকে দান করা হলো— সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তা অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলেও তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় জাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে।

তের.
কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারো কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি যাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয়, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। তাকে জাকাত দিতে হলে— নিয়ম হলো- প্রথমে তাকে জাকাত দেওয়া। এরপর সেখান থেকে ঋণ উসুল করে নেওআ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৭০; রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)

ঋণগ্রস্তকেই জাকাতের টাকা দেওয়া উত্তম। কেননা এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি যদি জাকাত গণ্য করার নিয়ত করা ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয়— তবে তো কথাই নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)