আলজেরিয়ার একটি বিয়ের ছবি।

প্রতিবছর রমজানের ২৬ তারিখ দিনগত রাতে পৃথিবীর বহু দেশেপবিত্র শবে কদর পালিত হয়। ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য ও ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় পবিত্র শবে কদর। মুসলমানদের কাছে কদরের রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন-হাদিসে এই রাতকে অত্যন্ত পুণ্যময় কলা হয়েছে।

কদরের এক রাতের ইবাদতে হাজার রাতের চেয়ে উত্তম বিনিময় পাওয়া যায়। এই রাতে মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করেন। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তার পূর্বাপর সব গুনাহ-ত্রুটি মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৪)

শবে কদর উদযাপন উপলক্ষে আমাদের বাংলাদেশে যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ওয়াজ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের কর্মসূচি নেওয়া হয় এবং পরের দিন সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও অত্যন্ত গুরুত্ব ও মহা আড়ম্বরতার সঙ্গে পালন করা হয় এই রাত।

মরোক্কোতে শবে কদর

মরোক্কোতে এই রাতে বাচ্চারাই সবচেয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। অভিবাবকরা এই রাতে বাচ্চাদের জীবনের প্রথম রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। তাদের জন্য নতুন পোশাক কিনে দেন। মেহেদি দিয়ে তাদের হাত রাঙিয়ে দেন। স্টুডিওতে গিয়ে তাদের ছবি তুলে আনেন।

রোজা রাখে না বলে বাচ্চাদের পুরো রমজান পুরো একটি ডিম খেতে দেওয়া হয় না। এই রাতে সর্বপ্র্রথম তাদের পুরো একটি ডিম খেতে দেওয়া হয়। তারা রোজা রেখেছে বলে এটি তাদের প্রতি বিশেষ সম্মানপ্রদর্শন। তাছাড়া বাচ্চাদের প্রথম রোজা রাখার কারণে ‘কুসকুস’ নামে এক ধরনের খাবার তারা রান্না করে মসজিদের দরজায় গরিব-মিসকিনদের খাইয়ে দেওয়া হয়। কুসকুস হচ্ছে উত্তর আফ্রিকার জনপ্রিয় খাবার। সুজির ছোট ছোট সিদ্ধ বল দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবার। সাধারণত তরকারির উপরে এটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সমগ্র উত্তর আফ্রিকার রন্ধনশৈলীতে কুসকুস উল্লে­খযোগ্য আসন দখল করে আছে। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, মৌরিতানিয়া ও লিবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের একটা ক্ষুদ্রাংশ এবং সিসিলির তরাপানিতে কুসকুস খুবই জনপ্রিয়।

এই রাতে ধূপ, পারফিউম, আতর ও পোশাক আশাক ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়। মরোক্কোবাসী এই রাতে তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করতে দলবেধে গোরস্থানে যায়। আত্মীয়দের নামে দান-সদকা করা হয়।

শবে কদরে আলজেরিয়া

আলজেরিয়াতেও এই রাতকে বাচ্চাদের প্রথম রোজা মনে করা হয়। এই রাতে প্রতি ঘরে ঘরে বিশেষ ধরনের শরবত বানানো হয়। যেসব বাচ্চা নতুন রোজা রেখেছে তাদেরকে তা খাওয়ানো হয়। পানি, মিষ্টি ও ফুলের পানি দিয়ে তৈরি এই বিশেষ শরবতের পাত্রে রেখে দেওয়া হয় একখানা স্বর্ণ বা রুপার রিং। খাবারের বেলায় একেক অঞ্চলে একেক ধরনের অভ্যাস।

এই রাতে আলজেরিয়াতে আরেকটি কাজ খুব গুরুত্বের সঙ্গে হয়ে থাকে। বিভিন্ন কল্যাণ সমিতি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যুবক-যুবতীদের যৌতুকবিহীন গণবিয়ের আয়োজন করা হয়। দরিদ্রতার কারণে যেসব যুবক-যুবতীর বিয়ের সুযোগ হয় না, তাদের গণবিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়েতে প্রতি বর ও কনের পরিবারের মেহমানসহ উপস্থিত অতিথিতিদের আপ্যায়ন হয়। খাবারের ম্যেনুতে থাকে হরেক রকমের ম‚ল্যবান ও সুস্বাধু খাবার ও কোমল পানীয়। সর্বশেষ পরিবেশন করা হয় মিষ্টি।

বিয়ে শেষে নব-দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হয় নানা উপহার সামগ্রী। এছাড়া তাদের পুনর্বাসনের জন্য দেওয়া হয় মূল্যবান বিভিন্ন সামগ্রী। অন্যদিকে যেসব বাচ্চা এ বছর নতুন রোজা রেখেছে তাদেরকে দেওয়া হয় নতুন পোশাক ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী।

২৭ রমজান যেভাবে কাটায় তিউনিশিয়ানরা

তিউনিশিয়াতেও এই রাতে অনেকে বিয়ে করেন। বিয়ের প্রস্তাবকারী পুরুষ ও নারী এই রাতে এক সঙ্গে বের হন। মার্কেট করেন। স্বর্ণ-গহনা কিনে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হন। এই রাতে তিউনিশিয়ায় বাচ্চাদের খতনা (মুসলমানি) করানো হয় এবং বড় করে অনুষ্ঠান করে সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়। বাচ্চাদের নুতন পোশাক কিনে দিয়ে তার পকেটে টাকা-পয়সা রেখে দেওয়া হয়। যাতে তারা তা পেয়ে খুশি হয়।

তিউনিশিয়ানরাও এই রাতে তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করে থাকেন। তাদের জন্য ইসালে সাওয়াব করেন।

লিবিয়ায় যেভাবে কাটে শবে কদর

লিবিয়াতে এই রাতে খাবারের বাহারটাই বেশি। গ্রামের মহিলারা এই রাত উপলক্ষে তৈরি করেন “বাজিন” নামক এক বিশেষ খাবার। যা তাদের কাছে খুবেই জনপ্রিয় স্বাস্থ্যসম্মত বলে পরিচিত। আর শহরের মহিলারা রান্না করেন কুসকুস। এটিও তাদের কাছে খুব প্রিয়।

মৌরতানিয়ায় শবে কদর

একশ ভাগ মুসল্লির দেশ মৌরতানিয়ার মুসলিমরা এই রাতে বিভিন্ন রকম ধূপ জ্বালায়। তাদের ঘরগুলোকে আতর দিয়ে সুবাসিত করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা এই রাতে সুই গরম করে বাচ্চাদের হালকা ছেকা দেয়, যাতে বাচ্চাদের (তাদের ধারণা অনুযায়ী) শয়তান ধরতে না পারে।

-আল-আরাবি আল-জাদিদ অবলম্বনে