রমজান গুনাহ মাফ ও ক্ষমা প্রাপ্তির মাস। অতীত পাপের দাগ দূর করে পরিচ্ছন্ন আত্মা লাভের মাস রমজান। জীবনে আমূল পরিবর্তনের মাস। ভালো কাজে অনুরাগী ও মন্দ কাজে বিরাগী হওয়ার মাস। শুদ্ধতার পয়গাম নিয়ে আসা— পবিত্র রমজান এখন বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে।

ক্ষমা লাভ করতেই হবে

রমজান শেষ হওয়ার আগেই মুমিনকে ক্ষমা লাভে ধন্য হতে হবে, নতুবা বড় অকল্যাণ রয়েছে। নবীজি (সা.)  বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলোধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফের আগেই তা বিদায় নিল।’ তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রমজান মাস পাওয়ার পরও যে তার গুনাহগুলো মাফ করাতে পারেনি, তার চেয়ে বড় হতভাগা আর কেউ নেই। এমন লোকের ব্যাপারে জিবরীল (আ.) বলেছেন, ‘তার ধ্বংস হোক’ আর নবীজি (সা.) বলেছেন ‘আমিন’। (অর্থাৎ এমন লোক সত্যিই কপালপোড়া) (মুসলিম, হাদিস : ২৫৫১)

অতএব গুনাহমুক্তির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে রমজানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আজকের ইফতারের ভেতর দিয়েই সমাপ্তি ঘটবে রমজানের।

হিসেবে আমাদের হাতে আছে আজকের কয়েক মুহূর্তই। এ সময়ের মধ্যেই ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাব্য উপায়গুলো অবলম্বন করতে হবে। নিজের সর্বোচ্চ ভালোটা ঢেলে দিতে হবে ক্ষমা লাভের প্রত্যাশায়। আমরা আরও যা যা করতে পারি—

দোয়ায় কাটাতে হবে শেষ সময়

প্রথমত, দোয়ায় মনোযোগী হওয়া। বিশেষত  ইফতারের পূর্বে আন্তরিকভাবে রোনাজারি করা।এ সময়ের দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না।  নবীজি (সা.)বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না: ইফতারের আগে রোজাদারের দোয়া, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া ও মজলুমের দোয়া।’(তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)

এছাড়াও রমজানজুড়ে যেসব নেক আমল করা হয়েছে, বিগলিত অন্তরে সেগুলো কবুলের দোয়া করতে থাকা। বিশেষত রোজা পালন, তারাবির নামাজ, নফল দান সদকা, সদকাতুল ফিতর যেনো আল্লাহ তাআলা তার নিজ দয়ায় ভুলচুক মার্জনা করে গ্রহণ করে নেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘এবং যারা দান করবার, তারা ভীত প্রকম্পিত হৃদয়ে ( তারা ভয় পায় যে তাদের দান কবুল হলো কিনা ) এ কারণে দান করে যে, তারা তাদের পালনকর্তার কাছে ফিরে যাবে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৬০)

আমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ শেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন যেন তার আমল কবুল হয়, অথচ তার আমলে বিন্দু পরিমাণও ঘাটতি ছিলোনা। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাদের থেকে কবুল করো। নিশ্চই তুমি শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৭)

সেই সঙ্গে এ ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে এবং দোয়াও করতে হবে— যেন শেষ সময়ের কোনো গর্হিত কাজের কারণে সারা রমজানের আমল বরবাদ হয়ে না যায়। আল্লাহ আমাদের বলেছেন, ‘আর তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার পাকানো সুতো শক্ত করে পাকানোর পর টুকরো টুকরো করে ফেলে।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯২)

তাওবা-ইস্তেগফার অব্যাহত রাখা

তাওবার উদ্দেশ্যে উত্তমরূপে অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুন। সাধারণ নফল নামাজ যেভাবে পড়েন, সেভাবেই পড়বেন। এরপর আন্তরিকভাবে তাওবা করে দোয়া করুন।

সায়্যিদুনা আবু বকর (রা.) বলেন, আমি নবীজি (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোনো বান্দা গুনাহ করার পর সুন্দরভাবে অজু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেন।’  অতঃপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেন, ‘এবং যখন তারা কোনো অন্যায় কাজ করে কিংবা নিজেদের উপর জুলুম করে, আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায়। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বারবার করে না।’ (তিরমিজ, হাদিস : ৪০৮; সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৫)

সুতরাং, আন্তরিকভাবে তাওবা করুন। তাওবা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আপনি যতদিন তাওবার উপর থাকবেন, ততদিন আল্লাহর ক্ষমা আপনাকে ঘিরে রাখবে।

অন্তরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে

ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন অন্তরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে; তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও করতে হবে। বিদ্বেষীকে আল্লাহ গুনাহ থেকে পবিত্র করেন না। হাদিসে এসেছে— ‘নবীজি (সা.) সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। একদিন তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিন রোযা রাখেন কেনো?” তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআ’লা সোমবার ও বৃহস্পতিবার এই দুই দিন প্রত্যেক মুসলমানের গুনাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু পরস্পর সম্পর্ক ছিন্নকারী সম্পর্কে (আল্লাহ বলেন), “তাদেরকে ছেড়ে দাও, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৪০)

প্রিয় পাঠক, রমজানের শেষ মুহূর্তে নিজের ভেতর থেকে সকল প্রকার রাগ, ঘৃণা,ক্ষোভ, ক্রোধ মুছে ফেলুন। মিটিয়ে ফেলুন— যত তিক্ত সম্পর্ক। নিজের অন্তরকে পরিষ্কার রাখুন। কারো প্রতিই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রাখবেন না। তবেই জুটবে ক্ষমা— খুব সহজে।

আল্লাহ কোরআনে তাদের প্রশংসা করেছেন, যারা দোয়া করেছিল— এই বলে যে, ‘হে আমাদের রব!  আমাদের এবং আমাদের সেই ভাইদের ক্ষমা করে দিন যারা আমাদের পূর্বে বিশ্বাস স্হাপন করেছে। আর আমাদের অন্তরে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ঘৃণা রাখবেন না। হে প্রতিপালক, নিশ্চয়ই আপনি অতি করুণাময়, পরম দয়ালু।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১০)

সুস্থ অন্তর ছাড়া গুনাহমুক্তি সম্ভব নয়। কোরআন বলছে, ‘যেদিন ধন সম্পদ ও সন্তানাদি কারো কোনো উপকারে আসবে না, একমাত্র ওই ব্যক্তি ছাড়া— যে সুস্হ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সুরা শুআরা, আয়াত : ৮৮-৮৯)

আপনি যদি আল্লাহর ক্ষমা পেতে চান, তাহলে আপনিও মানুষকে ক্ষমা করুন। আর এভাবেই অন্যকে ক্ষমা করে দিয়ে নিজে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশা নিয়ে রমজানকে বিদায় জানান।

মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সব নেক আমল কবুল করুন। আমাদের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করুন। আরও অনেক অনেকবার রমজানের সৌভাগ্য লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।