লোহিত সাগরের পাড়ে অবস্থিত পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া। সুদান, ইথিওপিয়া ও জিবুতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অসংখ্য দ্বীপের দেশ ইরিত্রিয়ার আয়তন ১ লক্ষ ২১ হাজার কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৫মিলিয়ন। মুসলিমদের হার শতকরা ৪৮ থেকে ৫৬ জন।

ইরিত্রিয়ার প্রসিদ্ধ শহরগুলো হলো- রাজধানী আসমারা, ক্রেইন, আসাব ও ম্যাসাভা। ইরিত্রিয়ানরা প্রায় ৯ ভাষায় কথা বলে। তবে সরকারি ভাষা হলো: তিগ্রিনিয়া, আরবি ও ইংরেজি।

দেশটি অতীতে ইতালি ও যুক্তরাজ্যের অধীনে ছিল। ১৮৯০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছিল ইতালিরে দখলদারিত্বে। এরপর ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ছিল বৃটিশদের অধীনে। ১৯৫২ সালে জাতিসংঘ ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়াকে ফেডারেল রাষ্ট্র ঘোষণা করে। ইরিত্রিয়া এই ঘোষণা না মেনে বিদ্রোহ করে। স্বাধীনতা অন্দোলনের ডাক দেয়। কারণ, ইথিওপিয়া দেশটিকে দখল করে বসে।

১৯৬১ সালে জাতিসংঘ ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিলেও ইথিওপিয়া সরে যেতে অস্বীকার করে। চলে দীর্ঘ যুদ্ধ। এক পর্যায়ে ইথিওপিয়া সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯৩ সালের ২৩ মে জাতিসংঘ ইরিত্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।

স্বাধীনতার পর সামরিক শাসনব্যবস্থা থেকে অর্গানাইজেশন অব পপুলার ফ্রন্ট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড জাস্টিস নামে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয় ইরিত্রিয়ায়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় বহাল রয়েছে— রাষ্ট্রপতি ইসাইয়াস আফওয়ার্কি। ক্ষমতা ধরে রাখতে রাষ্ট্রপরিচালনায় তিনি স্বৈরনীতি চর্চা শুরু করেন।

১৯৯৭ সালে সংবিধান বাতিল এবং ২০০১ সালে সংসদ স্থগিত করেন। সব দল ও সবধরনের নির্বাচন নিষিদ্ধ করেন। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করেন। বর্তমানে রষ্ট্রের কোনো সংবিধান, সংসদ ও রাজনৈতিক দল নেই। আরব লিগে যোগদান করার আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করে চলছে বারবার।

অন্যদিকে গভীর সম্পর্ক তৈরি করছে— ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাঈলের সাথে। বর্তমানে ইসরাইল লোহিত সাগরে ইরিত্রিয়ান দ্বীপ দাহলুক ব্যবহার করছে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করছে।

ইরিত্রিয়ায় ইসলামের যাত্রা

খ্রিস্টাব্দ ষোড়শ শতাব্দীতে আফ্রিকা হর্নে উসমানি খিলাফতের স্বাভাবিক উপস্থিতির পর ইরিত্রিয়ায় ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শতকরা ১০ ভাগ মুসলিম কোটা রয়েছে।

সম্প্রতি ইরিত্রিয়ান সরকার মুসলমানদের বিজ্ঞান শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে বিদেশে তাদের উচ্চ শিক্ষায় বিভিন্ন বিধি-নিষেধ রয়েছে। ফলে শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলিমসমাজ পিছিয়ে পড়ছে।

অত্যাচারে অতিষ্ঠ মুসলমানরা

শাসকগোষ্ঠীর নানাবিধ অত্যাচারে ইরিত্রিয়ার মুসলমানরা বর্তমানে নিদারুণ কষ্টে কালাতিপাত করছে। ইথিওপিয়ার সঙ্গে ফেডারেল সরকারের সময় মুসলিমরা যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো— সব বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে— অনেক ইসলামি প্রতিষ্ঠান। মসজিদগুলোও নিয়মিত প্রতিরক্ষা বাহিনী নজরদারিতে থাকে।

আরবি ভাষা ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার মুছে ফেলার জন্য বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী ও ইহুদী মদতপুষ্ট বর্তমান সরকার। ১৯৯৪ সাল থেকে ইসলামি অঙ্গনের প্রসিদ্ধ সব শিক্ষক, ইমাম ও বুদ্ধিজীবীদের বন্দি করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীতে নিষিদ্ধ করেছে আজান ও নামাজ।

১৯৯৩ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব সুদানের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক মিলিয়ন মুসলিম শরণার্থীকে দেশে ফিরে আনতে অস্বীকার করছে বর্তমান সরকার।

গুম, আটক ও বিচারবিহীন ফাঁসি

২০১৯ সালে হিউম্যান রাইটস এর ইরিত্রিয়া বিষয়ক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বিনা অভিযোগে আটক ও আটককৃতদের বিচারের মুখোমুখি না করা— সর্বোপরি গুমের ঘটনা ব্যপক আকার ধারণ করেছে। ছোট শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত— কেউ রেহাই পাচ্ছে না। কারাবন্দিরা অমানবিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। বিচারবিহীন ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে। এমনকি শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকসহ নেতৃত্ব পর্যায়ের সবাই এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

ইরিত্রিয়ার মুসলমানরা যেন বিশাল উন্মুক্ত কারাগারে বসবাস করছে। প্রতিনিয়ত তাদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও ধর্মীয় অধিকার হরণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল ও আরব তথা মুসলিম বিশ্বের নিশ্চুপ অবস্থানে তারা হতবাক ও বাকরুদ্ধ। বিশ্ব সম্প্রদায় ও মুসলিম বিশ্বের কাছে তাদের প্রত্যাশা— ইরিত্রিয়ার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের ওপর চলা নির্যাতনের ধারা অন্তত কিছুটা হলেও কমানোর জন্য এগিয়ে আসবে। 

কুয়েত থেকে প্রকাশিত আরবি ম্যাগাজিন ‘আল-মুজতামা’ অবলম্বনে