জুমার দিন। মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক উৎসবের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ ও অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্যপূর্ণ দিবস। আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ উপলক্ষ। ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র জুমা বারের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাসে এ দিনে ঘটেছে বড় বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ অনেক ঘটনা। ইসলামি ইতিহাসে জুমার দিনে সংঘটিত কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে পরিবেশন করব।  

এক. পৃথিবী সৃষ্টির পরিপূর্ণতা লাভ
আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল ও গ্রহ-উপগ্রহকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ভাষ‌্য হলো- ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি রাতকে দিন দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এমনভাবে যে, রাত দিনকে দ্রুত ধরে ফেলে। তিনি সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র-সূর্য ও নক্ষত্ররাজি স্বীয় আদেশে অনুগামী। জেনে রাখ, তারঁই কাজ সৃষ্টি করা ও আদেশ প্রদান করা। বড় বরকতময় আল্লাহ, যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৪) 

প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘সহিহ বর্ণনা অনুযায়ী যে ছয় দিনে জগত সৃষ্টি হয়েছে তা রবিবার থেকে শূরু করে শুক্রবারে শেষ হয়। ‘ইয়াওমুস সাবতি’ তথা শনিবার জগত সৃষ্টির কোন কাজ হয়নি। ‘সাবত’ অর্থ হলো কর্তন করা। এদিনে কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো বলে এদিনকে ইয়াওমুস সবতি’ তথা শনিবার বলা হয়।’

আলোচ‌্য আয়াতে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি ছয় দিনে সমাপ্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সুরা হামীম সিজদার নবম ও দশম আয়াতে এর বিশদ বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, দুদিনে ভূমণ্ডল, আর দুদিনে ভূমণ্ডলের পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, খনি, বৃক্ষরাজি, উদ্ভিদ ও জন্তু-জানোয়ারের খাদ‌্যসামগ্রী সৃষ্টি করা হয়েছে। মোট চার দিন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “দুদিনে তিনি ভূমণ্ডলকে সৃজন করেছেন।” এরপরের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, “চারদিনের মধ্যে তাতে তার খাদ‌্যের ব‌্যবস্থা করা হয়েছে”। যে দুদিনে ভূমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ছিল রবিবার ও সোমবার। এর পরের দুদিন ছিলো মঙ্গল ও বুধবার, যাতে ভূমণ্ডলের সাজ-সরঞ্জাম পাহাড়-পর্বত ও নদী-নালা সৃষ্টি করা হয়। এরপরে বলা হয়েছে- “অতঃপর সাত আকাশ সৃষ্টি করেন অন‌্য দুদিনে।” বাহ‌্যত এ দুদিন হবে বৃহস্পতিবার ও জুমাবার। এভাবে জুমমাবার পর্যন্ত ছয় দিন পূর্ণ হলো। সুতরাং পবিত্র জুমাবারেই পৃথিবী পূর্ণতা লাভ করে।    

দুই. আদিপিতা আদম আ.-এর সৃষ্টি ও মৃত্যু
সপ্তাহের অন‌্যান‌্য দিনের তুলনায় পবিত্র জুমার দিন অনন‌্য বৈশিষ্ট‌্যমন্ডিত হওয়ার অন‌্যতম কারণ হলো যে, এ দিনে সৃষ্টি হয়েছে মানবজাতির আদিপিতা হযরত আদম আ.।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবিজি সা. আমার হাত ধরে ইরশাদ করেন- “আল্লাহ তায়ালা শনিবার দিন জমিন সৃষ্টি করেছেন। রবিবারে সৃষ্টি করেছেন পাহাড়-পর্বতমালা। গাছপালা সৃজন করেছেন সোমবার দিন। মঙ্গল বার মন্দ জিনিসসমূহ সৃষ্টি করেছেন। বুধবার দিন তিনি আলো বা জ‌্যোতি তৈরি করেছেন। আর বৃহষ্পতিবারে তিনি জীবজন্ত ও প্রাণিজগৎকে সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। জুমার দিনের সর্বশেষ সময় আসরের পর ও মাগরিবরে পূর্ব মুহূর্তে সর্বশেষ সৃষ্টি হিসেবে তিনি আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন।” (মুসলিম, হাদিস : ২৭৮৯; আহমদ : খন্ড-০২, পৃষ্ঠা : ৩২৭)

উল্লেখিত হাদিসটি সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের বহু আলোচনা-পর্যালোচনা থাকলেও তা থেকে আদম (আ.)- এর সৃষ্টির ইতিহাস জানাই আমাদের মূল উদ্দেশ‌্য। এছাড়া অন‌্য হাদিস থাকলেও মুসলিম শরীফের গ্রহণযোগ‌্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক বিবেচনায় নিয়ে এ হাদিসটি আমরা গ্রহণ করেছি।  

প্রখ‌্যাত ইতিহাসবিদ ইবনু কাসির রহিমাহুল্লাহ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, আদিপিতা হযরত আদম আ. এ দিনেই ইন্তেকাল করেন। এ কিতাবে মৃত‌্যু পূর্ববর্তী সময়ে তাঁর ও তার পুত্র শিষের মধ‌্যকার কথোপকথনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ইবনু ইসহাক বলেন- তাঁর ইন্তেকালে পৃথিবীতে সাত দিন সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্র্রগ্রহণ হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে- আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সা. এরশাদ করেন-‘জুমার দিন হলো সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনেই তাকে সৃষ্টি বরা হয়। তাকে এ দিনেই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। এ দিনেই তাঁর তাওবা কবুল হয়। তাঁর ইন্তেকালও হলো এ দিন। কেয়ামত সংঘটিত হবেও এ দিনেই।’ (সহিহুল জামে-৩৩৩৪)   

তিন. আদম (আ.)-কে জান্নাতে প্রবেশ ও পৃথিবীতে প্রেরণ
এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত আছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ামাল্লাম বলেন– ‘সপ্তাহের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম দিন হলো জুমার দিন। এ দিনে পৃথিবীর প্রথম মানব আদম আ. সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ দিনেই তাকে জান্নতে প্রবেশ করানো হয়। এ জুমার দিনেই তাকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতেপ্রেরণ করা হয়। পবিত্র জুমার দিনেই সংগঠিত হবে কেয়ামত।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৪)     

এ পবিত্র ও মহিমান্বত দিনে আরোও অসংখ‌্য ও অগণিত ঘটনা ঘটেছে এবং ভবিষ‌্যতেও ঘটবে। তাই এ দিনের প্রতিটি সময় ও প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা এ দিনকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুক। আমিন।