পারস্পরিক ভালোবাসা, একে অপরের ওপর দয়া, অনুগ্রহ ও প্রশান্তির পবিত্র বন্ধনের নাম দাম্পত্য সম্পর্ক। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক শুধু সহবাস বা সংসারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এই সম্পর্ককে তার মহাশক্তির নিদর্শনগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বর্ণিত হয়েছে—

তার নিদর্শনের মধ্যে হল এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিণী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে। (সুরা আর-রূম, আয়াত : ২১)

নবী মুহাম্মদ (সা.) আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ও অনুসরণীয়। জীবন সুখী করতে তার ঘরোয়া জীবন বিশেষত স্ত্রীদের সঙ্গে আচার-আচরণগুলোও অনুসরণ করতে হবে। তার জীবন থেকে আমরা দাম্পত্য জীবনের পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সঠিকভাবে ভালোবাসার প্রকাশ শিখতে পারি।

ভালো স্বামী হবেন যেভাবে

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— ইমানের দিক থেকে পূর্ণতম মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। (তিরমিজি)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে-ই, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণ করে। আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণকারী। (ইবনে মাজাহ)

আরেক হাদিসে নবী (সা.) বলেন, কোনো মুমিন পুরুষ যেন মুমিনা স্ত্রীকে ঘৃণা না করে; তার কোনো একটি দোষ অপছন্দ হলে অন্য কোনো গুণে সে সন্তুষ্ট থাকবে। (মুসলিম)

আরও একটি হাদিসে তিনি বলেছেন, এই দুনিয়া সাময়িক আনন্দের স্থান, আর দুনিয়ার সেরা সম্পদ হলো সৎ ও ধর্মপরায়ণ স্ত্রী। (মুসলিম)

ভালোবাসা শুধু মুখে নয়, আচরণেও প্রকাশ করুন

আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) আমাকে একদিন পান করার জন্য একটি পাত্র দিলেন। আমি হায়েজ অবস্থায় থাকলেও তিনি আমার মুখের স্থানে মুখ রেখে পানি পান করলেন। (নাসায়ি)

আনাস (রা.) বলেন, নবীজির এক পারসি প্রতিবেশী তাকে খেতে আমন্ত্রণ জানান। নবী (সা.) বলেন, আয়েশাও কি আসতে পারবে? প্রতিবেশী না করলে নবী (সা.) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। তিনবার এমন হওয়ার পর প্রতিবেশী যখন আয়েশা (রা.)-সহ আমন্ত্রণ জানান, তখন নবী (সা.) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। (মুসলিম)

আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) ঘরে পরিবারের কাজে সাহায্য করতেন, আর নামাজের সময় হলে নামাজে দাঁড়াতেন। (বুখারি)

সংসারে হাসি-খুশি ও আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করাও ভালোবাসার অংশ

আয়েশা (রা.) বলেন, একবার আমি নবীজির সঙ্গে সফরে ছিলাম। নবী (সা.) সাহাবিদের সামনে এগিয়ে যেতে বললেন, তারপর বললেন, ‘চলো, দৌঁড়ে দেখি কে আগে যায়।’ আমি জিতে গেলাম।

কয়েক বছর পর আবার এক সফরে নবী (সা.) দৌঁড়ের প্রস্তাব দিলেন। আমি তখন একটু ভারী হয়ে গেছি। নবী (সা.) বললেন, ‘চলো আবার দেখি।’ এবার তিনি জিতলেন এবং হেসে বললেন, ‘এখন সমান হয়ে গেলাম।’ 

আরেকবার ঈদের দিন ইথিওপীয়রা মসজিদে ঢাল ও বর্শা নিয়ে খেলছিল। নবী (সা.) আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, খেলা দেখতে চাও? তিনি রাজি হলে নবী (সা.) তাকে নিজের পেছনে দাঁড় করালেন, নিজের গাল নবীর গালে লাগানো অবস্থায় আয়েশা খেলাটি দেখলেন। নবী (সা.) বারবার উৎসাহ দিচ্ছিলেন, চল, চালিয়ে যাও, হে বানু আরফিদা! (বুখারি)

মৃত্যুর পরও অটুট ভালোবাসা

নবীজি (সা.) প্রথম সহধর্মিণী ও জীবনের কঠিন মুর্হূতগুলোর সঙ্গী ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)। মৃত্যুর পরও তাকে স্মরণ করতেন রাসুল (রা.)। তার আত্মীয় স্বজন ও বান্ধবীদের খোঁজ-খবর নিতেন। তাদের উপহার পাঠাতেন।

আনাস (রা.) বলেন, নবীজির কাছে যখনই কোনো উপহার বা খাবার আসত, তিনি বলতেন, এটা ওমুকের কাছে দাও, সে খাদিজার বন্ধু ছিল।

আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন খাদিজার বোন হালাহ (রা.) দরজায় এসে অনুমতি চাইলেন। তার কণ্ঠ শুনে নবী (সা.) আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ! এটা কি হালাহ বিনতে খুয়াইলিদ? (বুখারি ও মুসলিম)

আয়েশা (রা.) নিজেই বলেন, আমি নবীর কোনো স্ত্রীকে এত হিংসা করিনি যতটা করেছি খাদিজাকে (রা.), যদিও তাকে কখনো দেখিনি। নবী (সা.) যখনই কোনো পশু জবাই করতেন, বলতেন— এটা খাদিজার বান্ধবীদের কাছে পাঠাও।’

একবার আয়েশা (রা.) খাদিজা সম্পর্কে এমন কিছু বলেছিলেন, যা নবী (সা.)-কে কষ্ট দেয়। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ আমার অন্তরে তার ভালোবাসা দান করেছেন।

স্ত্রী ও তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ

আনাস (রা.) বলেন, এক সাহাবি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের মধ্যে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কে? নবী (সা.) বললেন, আয়েশা। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, পুরুষদের মধ্যে? নবী (সা.) বললেন, তার বাবা। (ইবনে মাজাহ)

এই হাদিস ও নবী জীবনের চিত্রগুলো আমাদের শেখায় যে, স্ত্রীকে ভালোবাসা মানে তাকে সম্মান করা, পাশে থাকা, ভুলে ধৈর্য ধরা, সুখে-দুঃখে সঙ্গ দেওয়া।

দাম্পত্য জীবন সফল করতে প্রয়োজন মমতা, ধৈর্য, বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সম্মান। নবীজির জীবনের প্রতিটি আচরণ আজও মুসলমানদের জন্য এক অনন্ত অনুপ্রেরণা।

সূত্র : অ্যাবাউট ইসলাম

এনটি