ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এক অপূর্ব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক উৎকর্ষের সাক্ষী আব্বাসীয় খিলাফতের যুগ (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)। এ যুগে মুসলিম বণিকরা ভূমধ্যসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত, আটলান্টিক উপকূল থেকে মঙ্গোল সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল বাণিজ্যিক জাল বিস্তার করেছিলেন। এই স্বর্ণযুগের পেছনে ছিল কোরআন-সুন্নাহর অর্থনৈতিক নীতির পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯)  

এ আয়াতই ছিল আব্বাসীয় বাণিজ্যের মূল ভিত্তি। এ যুগের বাণিজ্যের কয়েকটি উজ্জ্বল দিক তুলে ধরা হলো।

বিশাল ভৌগোলিক পরিসর ও বাণিজ্যপথ

আব্বাসীয় যুগে মুসলিম বণিকরা স্থলে ‘সিল্ক রোড’ এবং সমুদ্রপথে ‘মশক ও লুবানের পথ’ নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাগদাদ, বসরা, সিরাফ, কায়রো, কর্ডোভা, সমরকন্দ, বুখারা—এসব শহর হয়ে উঠেছিল বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র। চীন থেকে কাগজ, রেশম, চিনামাটির পাত্র; ভারত থেকে মসলা, হীরা-মণি; পূর্ব আফ্রিকা থেকে সোনা, হাতির দাঁত, ক্রীতদাস; ইউরোপ থেকে ক্রীতদাস, লোহা ও কাঠ—সবই বাগদাদের বাজারে এসে মিলিত হতো।

সুদমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা

আব্বাসীয় বণিকরা মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা—এসব শরীয়াহসম্মত পদ্ধতিতে ব্যবসা করতেন। ধনী ব্যক্তি পুঁজি দিতেন, বণিক শ্রম ও দক্ষতা দিতেন, লাভ-লোকসান সমানভাবে ভাগ হতো। এতে শোষণের কোনো সুযোগ ছিল না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি সেই, যে মানুষের সাথে লেনদেনে সবচেয়ে সুন্দর।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭৪)

হিসবা ব্যবস্থা ও বাজার তদারকি

প্রতিটি বড় শহরে ‘মুহতাসিব’ নিযুক্ত থাকতেন, যিনি দাঁড়িপাল্লা যাচাই করতেন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন বন্ধ করতেন, মোনোপলি ভাঙতেন। খলিফা হারুন আর-রশিদ নিজে ছদ্মবেশে বাজারে ঘুরে মুহতাসিবের কাজ তদারকি করতেন। এই ব্যবস্থার কারণে বাজারে সততা ও ন্যায় ছিল অগ্রগণ্য।

বিশ্ব বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ

খলিফা মানসুর প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ শহরকে ‘মাদিনাতুস সালাম’ বলা হতো। এর কেন্দ্রস্থলে ছিল বিশাল বাজার। ইবন খুরদাদবিহ (মৃ. ৯১২ খ্রি.) লিখেছেন, ‘বাগদাদে এমন কোনো জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না।’ চীনা, ভারতীয়, আফ্রিকান, রোমান বণিকরা এখানে মিলিত হতেন। শহরের চারপাশে ছিল শত শত খাল, যা দিয়ে পণ্য পরিবহন হতো।

কাগজ শিল্প ও জ্ঞান-বাণিজ্যের বিপ্লব

সমরকন্দে চীনা যুদ্ধবন্দীদের মাধ্যমে কাগজ তৈরির কৌশল এলে বাগদাদে কাগজ কারখানা গড়ে ওঠে। ফলে বইয়ের দাম কমে যায়, জ্ঞানের বাণিজ্য বেড়ে যায়। বায়তুল হিকমাহ গ্রন্থাগারে লক্ষ লক্ষ পুঁথি ছিল, যেগুলো অনুবাদ ও বিক্রি করে বিশাল অর্থ উপার্জন হতো।

সাহাবী-তাবেয়ী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা

আব্বাসীয় বণিকরা সাহাবীদের ব্যবসায়িক আদর্শ অনুসরণ করতেন। আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) যেমন মদীনায় ব্যবসা করে কোটি কোটি দিরহামের মালিক হয়েও সব দান করে দিয়েছিলেন, তেমনি আব্বাসীয় যুগের বণিক জাবির ইবন আবদুল্লাহ আল-বাজালী এক কাফেলায় এত লাভ করেন যে, পুরো কাফেলার মাল বাগদাদের গরিবদের মাঝে বিতরণ করে দেন।

খলিফাদের ব্যক্তিগত অবদান

খলিফা মামুন আর-রশিদ চীনের সম্রাটের কাছে দূত পাঠিয়ে বাণিজ্য চুক্তি করেন। খলিফা মুতাসিম ভাইকিংদের সাথে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত বাণিজ্য চালু করেন। খলিফা হারুন আর-রশিদের যুগে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বছরে ৪০০ মিলিয়ন দিরহামের বেশি আয় হতো—যা তৎকালীন ইউরোপের যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

আব্বাসীয় যুগ প্রমাণ করে যে, যখন কোরআন-সুন্নাহর অর্থনৈতিক নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়, তখনই সমৃদ্ধি, ন্যায় ও শান্তি একসাথে আসে। আজকের মুসলিম উম্মাহ যদি সুদ ছেড়ে, জাকাত প্রতিষ্ঠা করে, সততার সাথে ব্যবসা করে, তবে আবারও সেই স্বর্ণযুগ ফিরে আসা অসম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলাম বিষয়ক গবেষক