রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের খবরে হতভম্ব হয়ে পড়েন সাহাবিরা। রাসুলের ইন্তেকালের খবর কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। ওমর (রা.) কোষমুক্ত তরবারি বের করে ঘোষণা দিয়ে বসেন, যে বলবে রাসুলের (সা.) ওফাত হয়েছে তাকে হত্যা করবো। 

এমন পরিবেশে দৃঢ় ও অবিচল ছিলেন আবু বকর (রা.)। তিনি সমবেত জনতাকে বলেন, যারা মুহাম্মদের ইবাদত করতে তারা জেনে রাখো, মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত করো তারা জেনে রাখো। আল্লাহ চিরঞ্জীব, তার মৃত্যু নেই।

তারপর এ আয়াত পাঠ করেন তিনি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল ছাড়া আর কিছু নন। তার পূর্বে বহু রাসুল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তাহলে তোমরা পেছনে ফিরে যাবে? যারা পেছনে ফিরে যাবে তারা আল্লাহ কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। যারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শিগগিরই আল্লাহ তাদের প্রতিদান দেবেন। (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৪৪)

আবু বকর (রা.)-এর মুখে এ আয়াত শুনার সাথে সাথে লোকেরা সম্বিত ফিরে পেলেন। এর মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের খবরে যে বিশঙ্খলা তৈরি হয়েছিল তার সমাধান হলো।

এরপর রাসুল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নিয়েও আনসার, মুহাজির সাহাবিদের মধ্যে কিছুটা বিভক্তি দেখা দেয়। তবে এ বিষয়টিরও সমাধান হয় আবু বকর (রা.)-এর হস্তক্ষেপে। সবার সিদ্ধান্তক্রমে খলিফা নিযুক্ত করা হয় তাকে। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর সমবেত মুহাজির ও আনসারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন-

‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলিফা নিযু্ক্ত করা হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি চাচ্ছিলাম, তোমাদের ম্ধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা যদি চান আমার আচরণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণের মতো হোক তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবী। ভুলত্রুটি থেকে ছিলেন পবিত্র। তার মতো আমার কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের কোনো একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবি আমি করতে পারি না।...আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি আমাকে সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবে ‘। 

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সেই সংক্ষিপ্ত নীতিনির্ধারণী প্রথম ভাষণটি চিরকাল বিশ্বের সব রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

রাসুল (সা.) ইন্তেকালের আগে সাহাবি উসামার নেতৃত্বে একটি বাহিনী সিরিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের খবরে বাহিনীর যাত্রা স্থগিত রাখা হয়। রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পরার পর আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দিকে নানা অপশক্তি নাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কেউ ইসলাম ত্যাগ করতে শুরু করে। কেউ যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কেউ নিজেকে নবী দাবি করে বসে। চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দেয়।

এই মুহূর্তে অনেকেই উসামার বাহিনীকে পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আবু বকর (রা.) কঠোর অবস্থান নিলেন এবং উসামার বাহিনীকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার নির্দেশ বহাল রাখলেন।

এ সময় আবাস ও জুবইয়ান নামের দুইটি গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। খলিফার দরবারের পরামর্শ সভায় অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু বকর (রা.) অটল থেকে আল্লাহর কসম খেয়ে বলেন, রাসুল (সা.)-এর যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো এখন যদি কেউ তা দিতে অস্বীকার করে, তবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো।

কিছু লোক মিথ্যা নবী দাবি করলো। আবু বকর (রা.) অসীম সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে এই ভন্ডদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইসলাম বিরোধীদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তার পর যদি আবু বকর (রা.) এমন দৃঢ়তা না দেখাতেন তবে মুসলিম জাতির ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।

(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১/২৪)

এনটি