ছবি : সংগৃহীত

সময়ের পরিক্রমায় বিদায় নিচ্ছে ১৪৪২ হিজরি। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন সন। সন্ধ্যা নামলেই উঁকি দেবে মুহাররমের নতুন চাঁদ। আকাশের রূপালি তারাদের পায়ে তাই ঝলমলে আলোর নাচন। নদীর তরঙ্গ, ঝর্ণার জলধারা আর পাখিদের মিষ্টি কলতানে আগমনী সুর আহলান, সাহলান শাহরু মুহাররাম। এ সুরের মোহনায় দুলে ওঠে ফুলের বাগান। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় আগরের ঘ্রাণ।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা)-এর ঐতিহাসিক ‘হিজরত’ এর নামে নামকরণ করা এই হিজরি নববর্ষ আগমনে প্রকৃতির আয়োজনে কোনো কমতি নেই। কিন্তু আমরা? আমরা যারা মুসলমান; নিজেদের মুমিন দাবি করি, তাদের হৃদয় কি খুশির জোয়ারে ভরে ওঠেছে? যতটা আনন্দিত হই নিউ ইয়ারে, যতটা উৎসবমুখর হই বাংলা নববর্ষে, হিজরি নববর্ষে কি ঠিক ততটা উচ্ছ¡সিত হয়েছি? আনন্দিত হওয়া তো পরের কথা, আমরা তো হিজরি বর্ষের দিন মাসের নামই জানি না।

এ কেমন মুসলমান আমরা! নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাহজিব-তামাদ্দুনের চর্চা না করে ভিন দেশ আর ভিন ধর্মের কৃষ্টিতে ডুবে আছি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আবার নিজেকে মুসলিম বলেও দাবি করছি। অথচ রাসুল (সা) বলেছেন, ‘সে আমার উম্মত নয়, যে অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা বজায় রাখে। তোমরা ইহুদি বা নাসারাদের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখ না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯৫)

একজন মুসলমান হয়ে ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রতি এতটা গাফেল থাকা সত্যি দুঃখজনক। অবশ্য এই উদাসীনতার পেছনে আমাদের দেশীয় মিডিয়ারও যথেষ্ট দায় আছে। নিউ ইয়ার এবং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্র মিডিয়ায় নানান আয়োজন থাকলেও হিজরি নবর্ষ উপলক্ষে থাকে না চার লাইনের কোনো কলাম কিংবা দশ মিনিটের সুস্থ বিনোদন। পচান্নবই ভাগ মুসলমানের দেশে তাই হিজরি নববর্ষকে মলিন বসনেই দিন পার করতে হচ্ছে প্রতি বছর। অথচ একটা সময় ছিল; যখন এই বাংলার মানুষই দিন তারিখ গণনায় প্রথমেই গুরুত্ব দিতেন হিজরি সনকে। পরে উল্লেখ করতেন বাংলা ও ইংরেজি। সে সময়টা ছিল ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার এর বঙ্গ জয়ের পর থেকে পরবর্তী ৬০০ বছর। তখনকার সময়ে প্রতিটি স্থাপনায়ই হিজরি সনের ব্যবহার হত। আর হবেই না কেন? এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে মুসলিম সভ্যতা, বিজয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নানান নিদর্শন। জড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিমের তাহজিব-তামাদ্দুন। সম্পৃক্ত ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান। এই যেমন- রোজা, হজ, ঈদ, শবে বরাত, শবে কদরসহ নানান আচার-অনুষ্ঠান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুহাম্মাদ-সা.) লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন- তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৯)

এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা বান্দার সময়ের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে চাঁদকে পঞ্জিাকাস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। হিজরি সনের সাথে ইবাদতের সম্পৃক্তার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা বুঝে আসে নবীজির এই হাদিসে, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙো।’ (মুসলিম, হাদিস : ১/৩৪৭)

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসের প্রেক্ষিতেই উলামায়ে কিরাম হিজরি সন গণনাকে ফরজে কিফায়া বলেছেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের ভাবা দরকার, আমাদের কি করার কথা আর আমরা কি করছি! কোন নববর্ষ উদযাপন করার কথা আর কোন নববর্ষ উদযাপন করছি। একজন বাঙালি হিসেবে যেমন বাংলা নববর্ষে আমরা উৎসবমুখর হই, তেমনি একজন মুসলমান হিসেবেও কি হিজরি নববর্ষে  উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা নয়? যতটা উৎসুক হয়ে বাংলা নববর্ষে বন্ধু-স্বজনদের মাঝে শুভেচ্ছা মেসেজ পাঠাই, তেমন উদ্দিপনায় কেন হিজরি নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করছি না? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি যেমন সত্য, তার থেকে আরো সত্য আমরা মুসলমান।’

মনে রাখতে হবে, হিজরি বর্ষপঞ্জি, অন্য বর্ষপঞ্জির মতো নয়। হিজরি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেই আমাদের চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সেই ত্যাগ-তিতিক্ষা আর ঘুরে দাড়ানোর ইতিহাস। প্রিয় মানুষ, আত্মীয়স্বজন, সম্পদ, বংশমর্যাদ ইত্যাদি ত্যাগ করে মুসলমানরা সেদিন হিজরত করেছিলেন এক আল্লাহর জন্য। আল্লাহর মনোনিত ধর্ম ইসলামের জন্য। পূর্ববর্তীদের এই ত্যাগে উজ্জিবীত হয়ে মুসলমান ইবাদতে গভীর মনোযোগি হোক, ভোগের জীবন ছেড়ে পরোপকারে নিয়োজিত হোক-এমনটাই চান মহান আল্লাহ। তাই  আসুন! একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেই হিজরি নববর্ষের ইতিহাস, প্রচলন।

 আমিনুল ইসলাম হুসাইনী।। ইমাম ও খতিব, কসবা জামে মসজিদ। কসবা, বি-বাড়িয়া।