প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী ও বিদগ্ধ হাদিসবিশারদ, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ও হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস, বহু গ্রন্থ রচয়িতা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। তার মৃত্যুতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ছাত্র-শিষ্য ও অনুরাগীরা বেদনাপ্লুত হয়েছেন।

তার জীবন ও কর্মপন্থা অনেক মানুষের জানার আগ্রহ। তাদের আগ্রহের কথা চিন্তা করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে জীবনের মৌলিক কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

জন্ম ও বংশধারা

শায়খ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ জুনায়েদ। কিন্তু সর্ব মহলে তিনি জুনায়েদ বাবুনগরী নামে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। তার জন্ম চট্টগ্রামে। ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর। ফটিকছড়ি থানার বিখ্যাত বাবুনগর গ্রামে।

তার পিতা শায়খুত তাফসির আল্লামা আবুল হাসান (রহ.)। তিনি ছিলেন হাদিসের জগতের মহান পণ্ডিত। বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মিশকাত শরিফের সুআদৃত ভাষ্য ‘তানজিমুল আশতাত’র রচয়িতা। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সিনিয়র উস্তাদ ও শায়খুত তাফসির ছিলেন।

শায়খ বাবুনগরীরর মায়ের নাম ফাতেমা খাতুন (রহ.)। তিনি বাবুনগর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হারুন বাবুনগরী (রহ.)-এর কন্যা। হারুন বাবুনগরীর পিতা সুফি আজিজুর রহমান (রহ.) ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তারা পর্যায়ক্রমে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বংশধর।

শৈশব ও পড়াশোনার সূচনা

শায়খ বাবুনগরীর পড়াশোনার সূচনা হয় তার মায়ের কাছে। এরপর বাড়ির পাশের প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। সেখানে তিনি মক্তব ও প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।

বাবুনগর মাদ্রাসায় তিনি পবিত্র কোরআনুল কারিম হেফজ সম্পন্ন করেন। হেফজ শেষে আল্লামা আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরী (রহ.)-এর কাছে তিনি ‘সাফিনা’ বা এক বৈঠকে পুরো কোরআন মুখস্ত শোনান।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা 

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভের জন্য শায়খ বাবুনগরী বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে ভর্তি হন।

শায়খ জুনায়েদ বাবুনগরী প্রখর মেধাবী ছাত্র ছিলে। শিক্ষাকালে তিনি প্রতিটি ক্লাসে তার মেধার সাক্ষর রেখেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়েঃ হাদিস সম্পন্ন করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায় তৎকালীন বড় বড় শায়খ ও শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদগণের মধ্যে আছেন- শায়খ আবদুল কাইয়ুম (রহ.), শায়খ মুফতি আহমদুল হক (রহ.), নিজের পিতা শায়খ আল্লামা আবুল হাসান (রহ.), আল্লামা আবদুল আজিজ (রহ.), মাওলানা খালেদ (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) প্রমুখ।

উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে বিদেশ পাড়ি

ইসলামি শরিয়তের ও হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে শায়খ জুনায়েদ বাবুনগরী বিদেশ গমন। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি (রহ.)-এর কাছে হাদিসের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে জামিয়াতু উলুমিল ইসলামিয়া, করাচির উলুমুল হাদিস (উচ্চতর হাদিস গবেষণা) বিভাগে ভর্তি হন।

সেখানে তিনি হাদিসের উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। দুই বছরের গবেষণা ও অধ্যয়ন শেষে তিনি একটি আরবি মাকালা বা অভিসন্দর্ভ লিখেন। সেটার ভিত্তিতে তাকে ওই বিভাগে সর্বোচ্চ সনদ দেওয়া হয়েছিল। তার সেই অভিসন্দর্ভের তার নাম ছিল ‘সিরাতুল ইমামিদ দারিমি, ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি।’ অর্থ : ইমাম দারিমি ও তার শিক্ষকদের জীবনবৃত্তান্ত।

অভিসন্দর্ভটির শুরুতে তিনি যুগ যুগ ধরে হাদিসচর্চা, ইলমে আসমায়ে রিজালের (হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনালেখ্য) ওপর দারুণ একটি অভিমতও লিখেন।

প্রখ্যাত মনীষীদের সান্নিধ্য অর্জন

করাচির বিন্নুরী টাউনে তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন- পৃথিবীখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)। এছাড়াও উপমহাদেরশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদ ও ফিকাহবিদ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.)-এর শিষ্য মাওলানা ইদ্রিস মিরাঠী (রহ.)। আরও ছিলেন আল্লামা আব্দুল্লাহ ইউসুফ নোমানী, তিনি তার সার্বিক তত্ত্বাবধান করতেন।

অন্যদিকে তিনি মাওলানা ওয়ালী হাসান টুঙ্কি (রহ.)-এর কাছে তিরমিজী শরিফ এবং মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)-এর কাছে বুখারি শরিফের দরস লাভ করেন।

১৯৭৮ সালে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের জন্য ভারতের স্বনামধন্য মনীষী শায়খ আবদুল কাদের রায়পুরীর খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত মাওলানা আবদুল আজিজ রায়পুরী (রহ.)-এর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। পবিত্র রমজান মাসে তিনি কিছুদিন উনার খানকায় ছিলেন। সেখানে তার সোহবতে থেকে আধ্যাত্মিকতাচর্চার অনুশীলন করেন।

শিক্ষকতা ও কর্মজীবন

উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৭৮ এর শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর প্রথমে তার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগ দেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে সিনিয়র শিক্ষক ও মুহাদ্দিস ছিলেন৷ টানা ২৪ বছর তিনি বিভিন্ন বিষয় ও শাস্ত্রের কিতাবাদি পাঠ দান করেন।

২০০৩ সালে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি নিয়োগ লাভ করেন। সেখানে বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মুসলিম শরিফ ও তিরমিজি শরিফ ইত্যাদি হাদিসের কিতাবের পাঠ দিতে থাকেন৷

জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউনের আদলে তিনি বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষাঙ্গনে প্রথমবারের মতো উলুমুল হাদিস বা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগের গোড়াপত্তন করেন। গত দুই বছর ধরে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদিসের পদ-মর্যাদা গ্রহণ করেন

লেখালেখি ও গ্রন্থ রচনা

শিক্ষকতার মহান পেশার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিতেও অভ্যস্ত ছিলেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ে বাংলা, আরবি এবং উর্দু ভাষায় বেশ কিছু কিতাব ও বইপত্র রচনা করেছেন। কিছু কিতাব ও বই প্রকাশিত হয়েছে। আর কিছু এখনও পাণ্ডুলিপি আকারে অপ্রকাশিত রয়েছে। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন দেশের আরবি ও উর্দু ভাষার জার্নালে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও কলাম প্রকাশিত হয়েছে।

তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সিরাতুল ইমামিদ দারিমি, ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি’ বা ইমাম দারিমি ও তার শিক্ষকদের জীবনবৃত্তান্ত (আরবি)। তালিমুল ইসলাম বা ইসলামের শিক্ষা (আরবি), ইসলামিক সায়েন্স, জুনায়েদ বাবুনগরীর রচনাসমগ্র ইত্যাদি।

মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমার চাদরে আবৃত করুন। অফুরন্ত রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে উত্তম ধৈর্য ধারণের তাওফিক দান করুন। এ অঞ্চলের মুসলিম জনগণের জন্য তর যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করে দিন। তার রেখে যাওয়া দ্বীনের শিক্ষামূলক কাজগুলো নিজ অনুগ্রহে অব্যাহত রাখুন।