প্রতীকী ছবি

ইবাদত পালনের জন্য ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্রতা অর্জন সাধারণত অজু, গোসল ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কোনো স্থানে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত পানি নেই, কিংবা পানি ব্যবহার ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর। এমন পরিস্থিতিতে ইসলাম তায়াম্মুম করার অনুমতি দিয়েছে।

এ বিষয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে থাকো কিংবা সফরে থাকো অথবা তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি প্রস্রাব-পায়খানা থেকে এসে থাকে, কিংবা নারীগমন করে থাকো, কিন্তু পরে যদি পানিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও। মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করে নাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৪৩)

তায়াম্মুমের সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আগের নবীদের উম্মত থেকে এই উম্মতকে তিন বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাতার ফেরেশতাদের কাতারের মতো বানানো হয়েছে, সারা ভূখণ্ডকে আমাদের জন্য মসজিদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পানি না পাওয়া অবস্থায় মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানানো হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ১/২০৯)

তায়াম্মুমের বিধান স্বীকৃত হওয়ার কারণ হলো- মানুষ অপারগতার সময়ও যেন ইবাদত থেকে বঞ্চিত না হয়। তায়াম্মুমের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। একজন পাঠক সহজেই তায়াম্মুমের যাবতীয় বিষয়াদি জেনে নিতে পারবেন।

তায়াম্মুম কী ও কাকে বলে?

‘তায়াম্মুম’ শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় তায়াম্মুম বলা হয় পবিত্রতার নিয়তে পবিত্র মাটির ওপর হাত মেরে চেহারা ও কনুই পর্যন্ত হাত মাসেহ করাকে। (আল-ফিকহুল ইসলামি, পৃষ্ঠা : ১/৪৯৮)

তায়াম্মুম বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি

আটটি শর্ত একসঙ্গে পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম শুদ্ধ হবে না।

এক. নিয়ত করা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ১/২৩২)

দুই. এমন কোনো ওজর (অপারগতা) পাওয়া যেতে হবে, যার কারণে তায়াম্মুম করা বৈধ হয়। তায়াম্মুম বৈধ হওয়ার অপারগ পরিস্থিতি হলো—

(ক) ব্যক্তি ও পানির মধ্যের দূরত্ব এক মাইল বা এর চেয়ে বেশি হওয়া। (দারাকুতনি : ৭৩১, ৭৩৪)

(খ) পানি ব্যবহারের কারণে রোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা অথবা প্রাণ বা অঙ্গহানির আশঙ্কা হলে। (দারাকুতনি : ৭৩১; কিতাবুল   আসার : ৭৪; সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি : ১১০৫)

(গ) পানি এত কম যে ব্যবহার করে ফেললে নিজে অথবা অন্যরা পিপাসাকাতর হয়ে পড়বে। (সুনানে কুবরা : ১১৪৯)

(ঘ) পাশেই কূপ বা পুকুর আছে, কিন্তু পানি এত নিচে যে তা থেকে পানি উঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। (সহিহ বুখারি : ২/৬১)

(ঙ) পানি কাছেই আছে, কিন্তু দুশমন অথবা ভয়ংকর কোনো পশু-প্রাণীর কারণে পানি অর্জন করতে অপারগ (সহিহ বুখারি : ২/৭২)

(চ) প্রবল ধারণা যে অজু করতে গেলে ঈদ বা জানাজার নামাজ ছুটে যাবে, তখন তায়াম্মুম করা যাবে। কারণ সেগুলোর কাজা বা বিকল্প নেই। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৩/৩০০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১১৫৮৬)

তিন. তায়াম্মুম পবিত্র মাটি দ্বারা হতে হবে। অথবা মৃত্তিকাজাত বস্তু দ্বারা। যেমন—পাথর, বালু, ধুলা ইত্যাদি। সুতরাং গাছপালা, সোনা, রুপা ইত্যাদি দ্বারা তায়াম্মুম জায়েজ নেই। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১৭১৬)

চার. পুরো মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত মাসেহ করা। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৩; দারাকুতনি : ৭১২)

পাঁচ. হাতের পুরো তালু অথবা বেশির ভাগ দ্বারা মাসেহ করা। যদি কেউ দুই আঙুল দ্বারা মাসেহ করে তাহলে তায়াম্মুম সহিহ হবে না। (দারাকুতনি : ৭১২; ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/৩৬৮)

ছয়. উভয় হাতের তালু মাটির ওপর দুইবার মারা—একবার চেহারা মাসেহের জন্য, আরেকবার উভয় হাত মাসেহের জন্য। একই স্থানে দুইবার মারলেও তায়াম্মুম হয়ে যাবে। তেমনি যদি শরীরে মাটি লেগে থাকে তাহলে তায়াম্মুমের নিয়তে মাসেহ করলেও তায়াম্মুম হয়ে যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/১৬১)

সাত. মাসেহ করার সময় চামড়ার ওপর কোনো প্রতিবন্ধক বস্তু থাকতে পারবে না; যেমন—মোম, চর্বিজাত দ্রব্য ইত্যাদি। যদি থাকে তাহলে ওসব বস্তু অপসারণ করা আবশ্যক; অন্যথায় তায়াম্মুম শুদ্ধ হবে না। (বায়হাকি : ৩৬৭)

আট. তায়াম্মুম চলাকালে তায়াম্মুমবিরোধী কোনো বিষয় না থাকা বা কাজ না করা; যেমন—নারীদের মাসিক, নেফাস অথবা প্রস্রাব-পায়খানা চলাকালে তায়াম্মুম করা। এ অবস্থায় তায়াম্মুম করলে তা শুদ্ধ হবে না। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ১/১৮১)

তায়াম্মুমের ফরজ কী কী?

তায়াম্মুমের ফরজ দুটি—

১. পুরো চেহারা একবার মাসেহ করা।

২. উভয় হাত কনুই পর্যন্ত মাসেহ করা। (দারাকুতনি : ৬৯৭)

তায়াম্মুমের সুন্নত কী?

নিম্নলিখিত বিষয়গুলো তায়াম্মুমের সুন্নত—

১. তায়াম্মুমের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া। (জামউল জাওয়ামে : ১/১৫৭৮৭)

২. ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৯)

৩. মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করার মাঝখানে অন্য কোনো কাজ না করা। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭২)

৪. মাটির মধ্যে হাত আগে-পিছে নড়াচড়া করা। (দারাকুতনি : ৬৯৭)

৫. মাটির ওপর হাত মারার পর উভয় হাত ঝেড়ে ফেলা। (মুসলিম, হাদিস : ৫৫৩; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৫৬৩)

৬. মাটির ওপর হাত রাখার সময় আঙুলগুলো খোলা রাখা। (দারাকুতনি : ৬৯৭)

তায়াম্মুম করার নিয়ম

তায়াম্মুম করার ইচ্ছাকারী ব্যক্তি উভয় হাতের কাপড়গুলো কনুইয়ের ওপরে উঠিয়ে নেবে। তায়াম্মুম দ্বারা নামাজ পড়ার নিয়ত করে বিসমিল্লাহ পাঠ করবে। নিজের উভয় হাতের তালুকে আঙুলগুলো খোলা রেখে মাটির ওপর রাখবে। হাতকে মাটির ওপর সামান্য ঘষবে। তারপর উভয় হাত উঠিয়ে ঝেড়ে ফেলবে। এরপর পুরো মুখমণ্ডল মাসেহ করবে।

অতঃপর আগের মতো উভয় হাতের তালু আঙুল খোলা রেখে মাটির ওপর রেখে সামান্য ঘষবে। এরপর নিজের বাঁ হাত দ্বারা ডান হাত কনুই পর্যন্ত মাসেহ করবে। এরপর ডান হাত দ্বারা বাঁ হাত কনুই পর্যন্ত মাসেহ করবে। তাতে তায়াম্মুম পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর তা দ্বারা ফরজ, নফল সব ধরনের ইবাদত আদায় করতে পারবে। (কিতাবুল আসার লি আবি ইউসুফ : ৭৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/১৬০)

যেসব কারণে তায়াম্মুম নষ্ট হয়ে যায়

১. যেসব কারণে অজু ভেঙে যায়, সেসব কারণে তায়াম্মুমও ভেঙে যায়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/১৬০)

২. পানি ব্যবহারে সক্ষম হয়ে গেলে, তায়াম্মুমের অনুমতি প্রদানকারী অপারগতা দূর হয়ে গেলে তায়াম্মুম ভেঙে যাবে। যেমন—দুশমনের ভয় খতম হয়ে গেলে, রোগের আশঙ্কা শেষ হয়ে গেলে ইত্যাদি। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/১৯২)

তায়াম্মুমের কিছু আনুষাঙ্গিক মাসআলা

কেউ যদি জানাজার নামাজ বা সিজদায় তিলাওয়াতের জন্য তায়াম্মুম করে, তাহলে ওই তায়াম্মুম দ্বারা যেকোনো নামাজ পড়া যাবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১১৫)

যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশের নিয়তে তায়াম্মুম করে, তার জন্য ওই তায়াম্মুম দ্বারা নামাজ পড়া জায়েজ হবে না। যে লোক কবর জিয়ারত বা মৃতকে দাফন করার জন্য তায়াম্মুম করবে, সে ওই তায়াম্মুম দ্বারা নামাজ পড়লে সহিহ হবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : হাদিস : ০১; হেদায়া : ১/২৭)

যে লোকের আশা আছে যে ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ পানি পাওয়া যাবে, তার জন্য তায়াম্মুমে বিলম্ব করা মুস্তাহাব। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/১৬০)

যাকে কেউ পানি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, তার জন্য তায়াম্মুমে বিলম্ব করা জরুরি। যার কাছে সামান্য পানি আছে, যা রুটি তৈরির জন্য খামিরা করতে লাগবে, সে পানি দ্বারা খামিরা তৈরি করবে, নামাজের জন্য তায়াম্মুম করবে। কিন্তু যার কাছে সামান্য পানি আছে, যা তরকারি রান্না করতে লাগবে, তাহলে ওই পানি দ্বারা অজু করবে, তরকারি রান্না করবে না। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি : ১১৪৮)

যদি কোনো ব্যক্তি এমন স্থানে থাকে, যেখানকার লোকেরা পানি দান করতে কার্পণ্য করে না, তাহলে তাদের কাছে পানি চাওয়া জরুরি। কিন্তু যেখানকার লোকেরা পানি দান করতে কার্পণ্য করে, সহজে পানি দেয় না, সেরূপ স্থানে কারো থেকে পানি চাওয়া জরুরি নয়; বরং তায়াম্মুম করতে পারবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৩৯; কাশফুল খেফা : ১/১২৪)

উভয় পা ও উভয় হাত কর্তিত ব্যক্তির মুখে জখম হলে পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই নামাজ পড়বে। যদি বেশির ভাগ অঙ্গ বা অর্ধাঙ্গ আহত হয় তাহলে তায়াম্মুম করবে। যদি বেশির ভাগ অঙ্গ ভালো থাকে, তাহলে অজু করবে, আর আহত স্থানে মাসেহ করবে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬; মুওয়াত্তা মুহাম্মদ : ২/৫৮৭)