কাবাঘরের সামনে পবিত্র মসজিদুল হারামে জুমার খুতবা দেওয়ার দৃশ্য। ছবি : সংগৃহীত

জুমার নামাজে উপস্থিত ব্যক্তিদের উপর নীরবতা পালন করে ইমামের খুতবা শোনা ওয়াজিব। অন্য কারও সাথে কথা বলা নাজায়েয। এমনকি সে কথা যদি অন্যকে চুপ করানোর জন্যও কথা হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি এমন কিছু করল, সে অনর্থক কাজ করল।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন ইমাম খুতবা দেওয়ার সময় আপনি যদি পাশের কাউকে বলেন, চুপ থাকুন; তাহলে আপনি জুমার সওয়াব নষ্ট করে দিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৯২; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৫১)

এই নিষেধাজ্ঞা শরিয়ত অনুমোদিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানকেও অন্তর্ভুক্ত করবে; অন্য দুনিয়াবি বিষয়গুলোকে তো করবেই।

আবুদ দারদা (রা.) বলেন: নবী (সা.) মিম্বারে বসে মানুষের উদ্দেশ্যে খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আমার পাশে ছিল উবাই ইবনে কাব। আমি তাঁকে বললাম: উবাই; এ আয়াতটি কখন নাযিল হয়েছে? তিনি আমার সাথে কোন সাড়া দিলেন না। আমি এরপরেও তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তারপরেও তিনি কোন সাড়া দিলেন না। এক পর্যায়ে রাসুল (সা.) যখন মিম্বার থেকে নামলেন তখন উবাই আমাকে বললেন: তুমি যে অনর্থক কথা বলেছ সেটা ছাড়া তুমি জুমার কোন সওয়াব পাবে না। অতঃপর রাসুল (সা.) যখন নামাজ শেষ করলেন, তখন আমি তার কাছে এসে বিষয়টি জানালাম। তখন তিনি বললেন, উবাই ঠিক বলেছে। যখন ইমাম কথা বলা শুরু করে তখন ইমাম কথা শেষ করা পর্যন্ত চুপ থাকবে”। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৭৮০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১১১১; তামামুল মিল্লাহ, হাদিস : ৩৩৮)

এ হাদিসটি প্রমাণ করে যে, জুমার দিন ইমামের খুতবাকালে নিরবতা পালন করা ওয়াজিব এবং কথা বলা হারাম।

ইবনে আবদুল বার বলেন, ফিকাহবিদদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, যে ব্যক্তির কানে খুতবার শব্দ পৌঁছে তার উপর চুপ থাকা ওয়াজিব। (আল-ইসতিজকার : ৫/৪৩)

খুতবার সময় চুপ থাকার হুকুম উল্লেখ করতে গিয়ে ইবনে রুশদ বলেন— যারা বলেন, “জুমার খুতবা চলাকালে চুপ থাকা ওয়াজিব নয়’ আমি তাদের মতের পক্ষে কোন ওজুহাত পাই না। তবে তারা যদি মনে করেন যে, এ নির্দেশটি কুরআনের আয়াতের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক তাহলে হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন কোরআন তেলাওয়াত করা হয় তখন কুরআন শুন এবং চুপ থাকো।’ [সুরা আরাফ, আয়াত: ২০৪] এর মানে কুরআন ছাড়া অন্য কিছুর জন্য চুপ থাকা ওয়াজিব নয়। তবে এ ধরনের দলিল দুর্বল। আল্লাহই ভালো জানেন। অধিক সম্ভাবনা হচ্ছে- এ মতের প্রবক্তাদের নিকট হাদিসটি পৌঁছেনি।” (বিদায়াতুল মুজাতাহিদ : ১/৩৮৯)

এ বিধান থেকে বাদ পড়বে— প্রয়োজনে কিংবা কল্যাণার্থে ইমামের সাথে কথা বলা এবং মুক্তাদিদের সাথে ইমামের কথা বলা।

আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর সময়ে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সে সময় একদিন নবী (সা.) জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন, সে মুহূর্তে একজন বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল: হে আল্লাহর রাসুল! সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজন ক্ষুধায় কাতর। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন। তখন তিনি দুই হাত তুললেন...। তাঁর দোয়ার ফলে সেদিন বৃষ্টি নামল, এরপরের দিনও বৃষ্টি হলো, এরপরের দিন, এরপরের দিনও বৃষ্টি হল, পরবর্তী শুক্রবার পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকল। সেই জুমাতে একই বেদুইন অথবা অন্য একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! ঘরবাড়ি ভেঙে যাচ্ছে। সম্পদ ডুবে যাচ্ছে। আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। তখন তিনি দুই হাত তুললেন...।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৯১; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৯৭)

জাবের বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারিম (সা.) জুমার দিন খুতবাদানকালে এক ব্যক্তি (নামাজে) এলো। তখন নবী (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে অমুক! তুমি কি নামাজ পড়েছ? সে বলল, না। তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৮৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৭৫)

যারা এ ধরনের হাদিসগুলো দিয়ে মুসল্লিদের পারষ্পারিক কথা বলা জায়েজ হওয়া কিংবা নীরবতা পালন করা ওয়াজিব নয় বলে দলিল দেন, তাদের অভিমত সঠিক নয়।

ইবনে কুদামা বলেন, তারা যে হাদিসগুলো দিয়ে দলিল দেন সে হাদিসগুলো কোনোটি ইমামের সাথে কথা বলার সাথে খাস; আর কোনোটি মুসল্লির সাথে ইমামের কথা বলার সাথে খাস। এতে করে খুতবা শুনায় কোন ব্যাঘাত ঘটে না। এ কারণে নবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন যে, তুমি কি নামাজ পড়েছ? সে ব্যক্তি নবী (সা.)-এর প্রশ্নের জবাব দেন। অনুরূপভাবে উসমান (রা.) খুতবা প্রদানকালে উমর (রা.) তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি প্রশ্নের জবাব দেন। তাই এ ধরণের হাদিসগুলোকে এ অর্থে গ্রহণ করা অনিবার্য; যাতে করে সবগুলো হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায়। অন্য কোন অবস্থাকে এর উপর কিয়াস করা সহিহ হবে না। কারণ খুতবা প্রদানকালে তো ইমামের অন্য কোন কথা বলার সুযোগ নেই; যেমনটি মোক্তাদিদের সুযোগ আছে। (আল-মুগনি, হাদিস : ২/৮৫)

পক্ষান্তরে, খুতবা চলাকালে হাঁচির উত্তর দেওয়া ও সালামের জবাব দেওয়ার মাসআলায় আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। ইমাম তিরমিজি তার ‘সুনান’ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) এর হাদিস “যদি আপনি আপনার পাশের লোককে বলেন...” বর্ণনা করার পর বলেন: সালামের জবাব দেয়া ও হাঁচির উত্তর দেয়ার ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। কোনো কোনো আলেম জুমার খুতবা চলাকালে সালামের জবাব দেওয়া ও হাঁচির উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে ছাড় দেন। এটি ইমাম আহমাদ ও ইসহাকের অভিমত। তাবেয়িদের মধ্যে কিছু আলেম ও অন্যান্য কিছু আলেম একে মাকরুহ বলেছেন। এটি ইমাম শাফেয়ির অভিমত।

স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্রতে (৮/২৪২) এসেছে, আলেমগণের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, খুতবা চলাকালে হাঁচির উত্তর দেওয়া ও সালামের জবাব দেওয়া জায়েজ নয়। কেননা হাঁচির উত্তর ও সালামের জবাব কথার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হাদিসের সাধারণভাবের দলিলের ভিত্তিতে খুতবা চলাকালে সব ধরনের কথা বলা নিষিদ্ধ।

স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্রতে (৮/২৪৩) আরও এসেছে, ইমাম খুতবা প্রদানকালে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে যদি খুতবার শব্দ শুনা যায় তাহলে উপস্থিত মুসল্লিদেরকে সালাম দেয়া জায়েয নেই। আর যারা মসজিদে আছে ইমামের খুতবা চলাকালে তাদের পক্ষ থেকেও সালামের জবাব দেয়া জায়েজ নয়।

ফতওয়া সমগ্রতে (৮/২৪৪) আরও এসেছে, জুমারদিন খতীবের খুতবা চলাকালে কথা বলা জায়ে নয়; তবে উদ্ভূত কোন বিষয়ে খতীবের সাথে কথা বলতে হলে সেটা জায়েয আছে।

শাইখ উছাইমীন বলেন, জুমার খুতবা চলাকালে সালাম দেওয়া হারাম। অতএব, ইমামের খুতবা চলাকালে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল তার জন্য সালাম দেয়া জায়েয নয় এবং অন্যদের সে সালামের উত্তর দেয়াও জায়েয নয়। (বিন উছাইমিনের ফতোয়াসমগ্র : ১৬/১০০)

শাইখ আলবানী বলেন, কাউকে এ কথা বলা যে, ‘চুপ থাকুন’ আভিধানিক অর্থে অনর্থক কথা নয়। কারণ, এটি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে অনর্থক কথা ও নাজায়েয হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খুতবাকালে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথা ‘খুতবা শুনার জন্য নিরবতা পালন’কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি এটাকে অনর্থক কথা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং যেসব কাজ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের সমপর্যায়ভুক্ত সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। আর যদি সমপর্যায়ভুক্ত না হয়ে নিম্নপর্যায়ের হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনর্থক ও নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। (আল-আজউয়িবা আন-নাফিআ, পৃষ্ঠা : ৪৫)

সারকথা হলো- জুমাতে উপস্থিত মুসল্লিদের উপর চুপ থেকে ইমামের খুতবা শোনা ওয়াজিব। ইমাম খুতবা প্রদানকালে কথা বলা নাজায়েয। তবে দলিলের ভিত্তিতে যে কয়টি বিষয় এ বিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে না সেগুলো ছাড়া; যেমন- খতিবের সাথে কথা বলা, কিংবা খতিবের কথা জবাব দেয়া, কিংবা কোন অন্ধকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার মত জরুরি কোনো বিষয় ঘটলে।

ইমামকে সালাম দেওয়া ও ইমামের পক্ষ থেকে সালামের জবাব দেওয়া এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, ইমামের সাথে কথা বলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কোনো প্রয়োজন কিংবা কল্যাণের স্বার্থে; এর মধ্যে সালাম দেওয়া পড়ে না।

শাইখ উছাইনিন তার রচিত ‘আল-শারহুল মুমতি’ (৫/১৪০) গ্রন্থে বলেন, কোনো কল্যাণের স্বার্থ ছাড়া ইমামের অন্য কোনো কথা বলা নাজায়েয। কথা বললে সেটা নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কল্যাণের স্বার্থে কিংবা যে বিষয়ে তখন কথা বলাটা ভালো এমন কিছু হতে হবে। এমন কোনো কল্যাণের বিষয় না হলে ইমামের কথা বলা নাজায়েজ।

আর কোনো প্রয়োজনের স্বার্থে কথা বলা আরও অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রয়োজনের মধ্যে পড়বে- শ্রোতা খুতবার কোন একটি বাক্য বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করা। কিংবা খতিব কোনো একটি আয়াতে এমন ভুল করলেন যা অর্থকে বিকৃত করে দেয়, এক্ষেত্রে খতিবকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া।