দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাংলাদেশে ফুটবল পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বাফুফে নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে। কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে নানা স্ট্যান্ডিং কমিটি থাকলেও নীতি-নির্ধারণ, চূড়ান্ত অনুমোদন, পর্যালোচনা হয় নির্বাহী কমিটির সভায়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ সেই নির্বাহী কমিটির সভা হয় না প্রায় এক বছর।

নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল ৯ নভেম্বর। সেই দিনের জরুরি সভার আলোচ্য বিষয় ফুটবল ও বাফুফের আভ্যন্তরীণ কার্যক্রম কিছু ছিল না; বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে বাফুফে কাউন্সিলর নির্ধারণই ছিল একমাত্র আলোচ্য বিষয়। জরুরি সভার আগে সাধারণ নিয়মিত সভা শেষ অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর। সেই সভা আবার ছিল ১৭ জুলাইয়ের মুলতবিকৃত সভার অংশ। সেই হিসেবে আনুষ্ঠানিক সাধারণ নির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১১ মাসের বেশি সময় আগে। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিনিয়র জাতীয় পুরুষ দল সাফল্য না পেলেও বাংলাদেশের ফুটবলে মাঠে ও মাঠের বাইরের ব্যস্ততা অনেক। গত কয়েক মাসে অনেক ইস্যুর সৃষ্টি হয়েছে যা নির্বাহী কমিটিতে আলোচনাযোগ্য ছিল। আবার অনেক কিছু হয়েছে যা নির্বাহী কমিটিতে থেকেও অনেকে জানেন না। 

প্রিমিয়ার লিগ শুরুর আগে বাফুফে নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের ক্লাবের পরিচয়ে ডাগআউটে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ৩০ জানুয়ারি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন লিগ শুরুর আগে এক অনুষ্ঠানে এই বিষয়টি নির্বাহী সভায় সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলেন। আগামীকাল মঙ্গলবার লিগের ১৬তম রাউন্ড শুরু হলেও এখনো নির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়নি৷ 

প্রিমিয়ার লিগ আর ৬ রাউন্ড পর শেষ হবে। প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ইতোমধ্যে শেষ। এবারের এই লিগে ফিক্সিং নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। এতটাই আলোচনা যে ফুটবলাঙ্গনে অনেকে এই লিগের নাম ‘ফিক্সিং লিগ’ও দিয়েছে। ফিক্সিংয়ের আকার ভয়াবহ রূপ ধারণ করলেও এই বিষয়ে বাফুফে নির্বাহী কমিটি জরুরি বা সাধারণ সভা আহ্বানের প্রয়োজন মনে করেনি। গতানুগতিক পাতানো খেলা শনাক্তকরণ কমিটির উপর দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার থাকার চেষ্টা। 

ফিক্সিংয়ের মতোই পুরো মৌসুমজুড়ে আলোচনায় রেফারিং। রেফারিংয়ের সিদ্ধান্ত এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল যে বিদেশি রেফারি আনার প্রস্তাব ছিল ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে। বাফুফে সভাপতি নিজেও স্বীকার করেছেন রেফারিং দুর্বলতা বিষয়টি। ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেফারিং নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হওয়ায় বিষয়টি নির্বাহী কমিটি আলোচনাযোগ্য ছিল। রেফারিজ কমিটি রেফারি-ক্লাব দুই পক্ষকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে৷ নির্বাহী সভা না হওয়ায় কিছু ম্যাচে বিদেশি রেফারি এনে পরিচালনা করার সম্ভাব্যতা বাস্তবে রুপ নেয়নি। 

লিগের কিছু ইস্যুর মতো জাতীয় দলেও ইস্যু রয়েছে। নির্বাহী সভায় জাতীয় দলে পেশাদার ম্যানেজার নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হলেও এখনো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। টুর্নামেন্ট ভেদে পরিবর্তন হচ্ছে ম্যানেজার। কখনো বাফুফে নির্বাহী কমিটির আবার কখনো নির্বাহী কমিটির বাইরের কাউকে অ্যাডহক ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে দায়িত্ব। 

ফিফা-এএফসির নির্দেশনায় বাফুফেতে পেশাদার জনবল অনেক। গত ১২ জুনের নির্বাহী সভায় সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করা হয়৷ পাশাপাশি ডেপুটি সাধারণ সম্পাদক নিয়োগের ব্যাপারেও আলোচনা হয়। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়৷ 

গত বছর জুলাই আগস্টের দিকে শোনা গিয়েছিল বাফুফেকে নির্বাহী কমিটির আকার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে ফিফা। এই উপলক্ষে ৪ সদস্যের একটি কমিটিও হয়েছিল৷ ১৬ সেপ্টেম্বরের পর আর সভা না হওয়ায় বাফুফে নির্বাহী কমিটির অনেকেই এর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত। 

এ রকম অনেকেই অনেক বিষয়ে অজ্ঞাত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাফুফে থেকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ৪৫০ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প দেয়া হয়েছে। ফুটবল উন্নয়নে এত বড় প্রকল্প দেয়া হয়েছে নির্বাহী কমিটির সভা ছাড়াই। নির্বাহী কমিটির অনেকের মন্তব্য, 'আমরা সবাই ফুটবল ভালোবাসি ও উন্নয়ন চাই। এই প্রকল্পটি নির্বাহী সভায় আলোচনা হলে সবাই আলোচনা করলে আরো বেশি সুন্দর হতে পারত।' 

নির্বাহী কমিটির সভা না হওয়ায় এ রকম অনেক অনুমোদনহীন অনেক কর্মকাণ্ডই হচ্ছে। এতে কমিটির মধ্যে একে অন্যের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নির্বাহী কমিটির ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন সদস্য। অনেক বিষয়ে সদস্যরা উপেক্ষিত হন৷ সহ-সভাপতিরাও অনেক বিষয় জানতে পারেন বিলম্বে। দীর্ঘদিন নির্বাহী সভা না হওয়ায় ক্ষোভ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবে এসব ক্ষোভ, অনুরাগ কমিটির বাইরে ফুটবলাঙ্গনে বললেও সভার সময় নিশ্চুপ থেকে যৌক্তিক ও ফুটবলের স্বার্থে সঠিক কথা বলতে অনেকে কার্পণ্য করেন৷ এই নিশ্চুপতার প্রভাব দেশের ফুটবলের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পড়ে!  

দীর্ঘদিন নির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত না হলেও গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয় অবশ্য ঘটেনি। বছরে কমপক্ষে ৩টি সভা করা বাধ্যতামূলক। ২০২০ সালের অক্টোবরে নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব নিয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৪টি নিয়মিত নির্বাহী সভা হয়েছে ৷ গত বছর অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো একটি জরুরি সভা হলেও কোনো নিয়মিত সভা হয়নি। গঠনতন্ত্র রক্ষার্থে অক্টোবরের মধ্যে ন্যূনতম ২টি সভা করতে হবে। 

এজেড/এটি