বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির শুরু সেই জন্মলগ্ন থেকে। ‘ক্রিকেটের এলিট ক্লাব’ অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের পথচলাও পার হয়েছে দুই দশক। এই সময়ে বাংলাদেশের নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিল প্রতিবেশি দেশ ভারত। ওই দেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন ঢাকা পোস্টকে শুনিয়েছেন তার চোখে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার গল্প… 

১০ নভেম্বর ২০০০, ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আইসিসির দশম স্থায়ী সদস্য হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় বাংলাদেশের, প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। সেটা ছিল সব বাঙ্গালীদের একটা গৌরবের দিন। যারা মনে প্রাণে বাঙ্গালি, যে দেশেই থাকুক না কেন, বাঙ্গালীদের যে কোন গৌরবে তাদের ও বুক ফুলে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল অবধি এমনটাই ঘটে এসেছে এবং এখন ও ঘটছে সৌরভ-সাকিবদের আমলে। এর আগে ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে প্রথম আবির্ভূত হয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাদের কে আর বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জেতে ৬২ রানে। 

তবে এই অভিষেকের ব্যাপারে যে নামটা না নিলে অন্যায় হবে সেটা হলো জগমোহন ডালমিয়া। যার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এই সাফল্য ঘটাতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, ২৬ জুন ২০০০ এ বাংলাদেশ হয়েছিল আইসিসির স্থায়ী সদস্য। শুধু বাঙালিদের নিয়ে গড়া একটা দল, ভাবতেই মনে একটা শিহরণ হতো, তাই নজর থাকত তাদের পারফরম্যান্সের দিকে, তাদের যে কোন সাফল্য এনে দিত মনে খুশীর জোয়ার।

২০০১ থেকে ২০০২ সময়টা ঠিক ভালো কাটেনি। ২০০৩ এর প্রথমদিকটা ও না, তবে ২০০৩ এর সেপ্টেম্বরে আসতে চলেছিল প্রথম টেস্ট জয়, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ম্যাচটা জিতে যায় এক উইকেটে। পরের বছর ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ এ, তাদের ১০০তম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে জেতে বাংলাদেশ, বুক ফুলে না উঠলেও আনন্দ যথেষ্ট হয়েছিল, জানতাম এই জয় তাদের মনোবল এতোটাই বাড়িয়ে দেবে যা তাদের ভবিষ্যতে অনেক অনেক সাফল্য আনতে বাধ্য করবে।

ঠিক তেমনটাই হয়েছিল, কয়েক দিন পরই জিম্বাবয়েকে হারিয়ে প্রথম টেস্ট জেতে বাংলাদেশ, জানুয়ারি ২০০৫ এ। ২২৬ রানের বড় ব্যবধানে জেতে বাংলাদেশ। আর সেই বছরেই এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে  ৫ উইকেটে হারায় অস্ট্রেলিয়াকে। দুর্ধষ্য ছিল পন্টিংয়ের সেই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দল, অন্যান্য দলের তুলনায় তাদের মান ছিল অনেকটাই উঁচু। সমস্ত বিশ্বে সাড়া পড়ে গিয়েছিল, সবাই অন্য চোখে দেখতে শুরু করে বাংলাদেশকে,আমাদের দেশেও তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের বিশাল । এরপর থেকে দুই রকমের ফরম্যাটেই অন্যান্য স্থায়ী দল গুলোর মত চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে তাদের ক্রিকেট যাত্রা, আর মাঝে মধ্যেই আসতে থাকে কিছু কিছু বিশেষ সাফল্য।

বিশ্বকাপ ২০০৭, ১৭ মার্চ একটা বড়সড় অঘটন ঘটায় বাংলাদেশ, তারকাখচিত ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে। কে ছিল না সেই ভারতীয় দলে? ২০০৩, বিশ্বকাপ যেতার স্বপ্ন নিয়ে যে দলটা দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে ফাইনালে হেরে যায় সেই দলের সেরাদের প্রায় সকলেই ছিল। বরং দলটাকে মনে হয়েছিল বুঝি আরও মজবুত। সেদিন বাংলার মাশরাফি, রাজ্জাক, রফিকরা বুক চিতিয়ে বল করেছিল- মহারাজ আর যুবরাজ ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারেনি তাদের বিরুদ্ধে। ৪৯ ওভার ৩ বলে ১৯১ রানে মুড়িয়ে যায় ভারত। লক্ষ্যে স্থির ছিল বাংলাদেশ, তামিম, মুশফিকুর, সাকিবরা ৪৮.৩ ওভারে দল কে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। 

প্রায় সকলেরই অভিমত ছিল সবটার জন্য চ্যাপেলই দায়ি, তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল দিকে দিকে, জানি না কজনের তাতে মনের জ্বালা জুড়িয়েছিল। আমি কিন্তু সেদিন সত্যি সত্যি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন শুনেছিলাম আর মনে আশা রেখেছিলাম ভবিষ্যতে এই গর্জন আরও অনেক শুনতে পাব।

তেমনটাই পেয়েছিলাম বিশ্বকাপ ২০১৫ তে ,সমস্ত বাংলাদেশ টিমটা যেন টগবগ করে ফুটছিল। অভিজ্ঞ সাকিব, মুশফিকুর, তামিম, রুবেল, মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি মোর্তজাদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন যুবা, সৌম্য সরকাররা। নিউজিল্যান্ডের বিশ্বত্রাস বোলিং এর সামনে- যেখানে অজিদের ও অসহায় দেখাচ্ছিল, তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিল বাংলাদেশ। গোটা বিশ্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল নিজেদের দিনে তারা যে কোন টিমকে তছ্নছ করার ক্ষমতা রাখে। অপেক্ষা করছিল সেমি-ফাইনালে যাবার জন্য শেষ পাঞ্চ মারার, ২০০৭ এর মত ভারত কে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিতে । সমস্ত বাংলাদেশ প্রেমি স্ব্প্ন দেখছিল সেমিফাইনালে যাবার। এমনকি আমার মত লাখ লাখ বাঙ্গালি, যাদের পূর্বপুরুষদের কিছু কারণে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে কিন্তু বীজ টা ওখানেই রয়ে গেছে, টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সেই ম্যাচ দেখার।

স্ব্প্নভঙ্গ সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু আমাদের কাছে দুঃখদায়ক হয়ে উঠেছিল তার পরবর্তি ঘটনাগুলো। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত ক্রিকেটের অঙ্গ হিসেবেই মান্য হওয়া উচিত। এমন ঘটনা অতীতেও বহু ঘটেছে, বর্তমানে ঘটে চলেছে আর ভবিষ্যতেও ঘটবে। তার দায় অন্যের ওপর চাপানো অন্যায়্। আমাদের বাঙ্গালীদের জিনেই বোধ হয় উন্মাদনা থাকে, আবেগে তারা হয়ে উঠে বিহ্বল,তা বিশ্বের যে কোন কোনারই বাঙ্গালী হোক না কেন। মস্তিকের চেয়ে হৃদয়ের অনুভূতি প্রকট হয়ে উঠে। আমরা বাঙ্গালী হয়ে সেটা উপলবদ্ধি করতে পারি, কারণ বাঙ্গালীরা এমনটাই হয়। সৌরভের লর্ডসের মাঠে জামা খুলে ঘোরানোটাও এমনি একটা ব্যাপার। কিন্তু বারবার করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ মন্তব্য আর পরবর্তী কালে খেলোয়াড়দের নিয়ে করা কদর্য কার্টুন ভারতে তাদের  সমর্থকদের মনে তিক্ততা এনে দিয়েছে,খোয়া গেছে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী। 

আমরা কিছু এখানের বাঙ্গালীরা তবু এখনো আগের অনুভূতি নিয়েই আছি। সেই ১৯৯৯ থেকেই কুইজ করা হতো, বলতো বিশ্বকাপে এবার কজন বাঙ্গালী খেলছে? সাকিব যখন কেকেআর-এ ছিল, সান্ত্বনা পেতাম একজন বাঙ্গালী তো কলকাতা টিমে আছে। এখনো বাংলাদেশের প্রতেটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুসরণ করি, সাফল্যে মন আনন্দে ভরে উঠে, বিপর্যয়ে কষ্ট পাই। তাই গত বিশ্বকাপের পর প্রথমেই মনে হয়েছিল, ম্যান অব দি টুর্নামেন্টটা সাকিবেরই প্রাপ্য ছিল।

আমার সবিনয় নিবেদন একটাই , আমাদের প্রতিবেশি আরেক রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা,তাদের ১৯৮১ তে টেস্ট অভিষেক হয়, আর পনের বছরেই হয় বিশ্ব্কাপ জয়। বাংলাদেশ  কি পারে না কিছুটা তাদের মত হতে, মনভাবটা বদলাতে, একটু নম্র-শান্ত হতে| বাংলাদেশ গণমাধ্যম কি পারে না দলকে সেভাবে উদ্বুদ্ধ করতে। দলে কে নেই , আছে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার, ডিনামিটের মত ফাস্ট বোলার, নিপুন স্পিনার আর প্রায় সবারই আছে ব্যাট করার ক্ষমতা। শুধু ‘জানি কিন্তু মানি না’ মনভাবটা পাল্টাতে হবে।

তৈরি হও বাংলাদেশ, পরের বিশ্বকাপের জন্য ,হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে, পারবেনা শ্রীলঙ্কা হতে? ছোটরা তো পেরেছে, পাবে তো ঘরের মতই পরিবেশ, চেষ্টা কর তোমাদের স্বপ্ন পূরণের।

শুভজিৎ মুস্তফি :

ভারতের সিনিয়র ক্রিকেট অ্যানালিস্ট। জন্ম কলকাতায় হলেও বেড়ে উঠেছেন মুম্বাইয়ে। গত এক যুগে কাজ করেছেন টাইমস গ্রুপ, হিন্দুজা গ্রুপ, জি গ্রুপ, সকাল মিডিয়া, স্পোর্টসকিড়াতে। পিএইচডি করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটি থেকে।