মোহাম্মদ মহসিন: সীমাবদ্ধতা পেছনে ফেলে জন্ম দিয়েছেন এক বীরত্ব গাঁথার

কিছু বুঝে ওঠার পর থেকেই অবহেলা আর করুণা নিত্যসঙ্গী ছিল তার। যেখানেই গেছেন, জুটেছে তাচ্ছিল্য, কেউবা তাকে দেখে করুণায় আদ্র হয়েছেন। কিছু করতে গিয়েও হয়েছেন অবহেলার শিকার। এ যেন প্রতি পদক্ষেপেই এক যন্ত্রণার গল্প। পদক্ষেপ শব্দটা বুঝি এখানে ঠিক মানানসই হচ্ছে না। কারণ তার যে দু’পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সাধ্যটুকুও নেই। তারপরও ‘হাল ছেড়ো না’ এই গানটাকে নিজের করে নিয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়। সকল সীমাবদ্ধতা পেছনে ফেলে জন্ম দিয়েছেন এক বীরত্ব গাঁথার। যার প্রতি পৃষ্ঠায় শুধু দুঃসাহসের কাব্য। 

মোহাম্মদ মহসিন শারীরিক প্রতিবন্দী এক মানুষ। ‘হাঁটি হাঁটি পা’ করার আগেই হারিয়ে ফেলেছেন হাঁটার শক্তিটুকুও। বয়স যখন ছয় মাস তখনই হঠাৎ একদিন এলোমেলা হয়ে গেল সবকিছু। পুরো শরীরটাই অবশ হয়ে যায়। তার দরিদ্র বাবা সীমিত সাধ্যের মধ্যে চেষ্টাটাও কম করেননি। ডাক্তার কবিরাজ কত জনের কাছে যে ছুটে গেছেন। সময় ব্যয় হয়েছে। টাকা খরচ হয়েছে। লাভ হয়নি কিছুই। শেষ পর্যন্ত পোলিও তার দুটো পা অবশ করে দেয়।

তারপরই জীবনের আরেক রূপ দেখতে হয়েছে তাকে। সেইসব দিনের কথা ভাবলে এখনো একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। বিমর্ষ মোহাম্মদ মহসিন ‘আমার দিন’কে বলছিলেন, ‘আমি যে অন্যদের মতো নই, সেটা সেই শিশু বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়ির পাশেই প্রাইমারী স্কুল। কিন্তু এক দৌড়ে ক্লাসে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে স্কুলে যেতাম আমি। কখনো বা ছোট বোন কাঁধে করে নিয়ে যেতো। কাজ না থাকলে আম্মার কোলে উঠে যেতাম স্কুলে।’

ব্যাট হাতে মহসিন, হারতে নারাজ

মহসিনের জন্ম ঢাকা শহরের পাশে গাজীপুরে। সেখানে টঙ্গীর মরুকন গ্রামে কেটেছে তার শৈশব। দুটো পা অবশ। হুইল চেয়ারও নেই। এমন একজনের শৈশবটা কেমন হবে তা তো আঁচ করা যায়।

কিন্তু মহসিন চার দেয়ালে নিজেকে বন্দী করে রাখতে চাইতেন না। তাইতো হামাগুড়ি দিয়ে দুপুর গড়াতেই চলে যেতেন মাঠে। যেখানে বন্ধুরা ফুটবল ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত। ইচ্ছে করতো তাদের সঙ্গে নেমে পড়ার, ‘বন্ধুরা খেলছে দেখে খুবই কষ্ট হতো। ওদের বলতাম, আমাকেও তোমাদের সঙ্গে খেলায় নাও। আমার যে খুব খেলতে মন চাইছে। আমার এমন অনুনয়ে মন ভিজতো তাদের।’

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর থেকেই ক্রিকেট তার মগজে ঢুকে পড়ে। তার আগে অবশ্য ব্যাডমিন্টনেও ঝোঁক ছিল। বয়স যখন ১৩ পেরিয়ে, তখনই একই হুইল চেয়ার পেয়ে যান এক এনজিও থেকে। ব্যস, বদলে যায় মহসিনের জীবন, ‘হুইল চেয়ার চালানোটা সহজ ছিল না। সেটা রপ্ত করতেই দেখা গেল বন্ধুরা আমাকে দলে নিচ্ছে। কিন্তু কোন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ দলে আর ডাক মিলতো না। বলতো তুই পারবি না।

মন খারাপ করা সেই সময়টাতে একদিন ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেন তিনি। যেখানে দেখা যায় হুইল চেয়ারে বসে ব্যাট করছেন। এই ছবিটাই ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ২০১০ সালটা তার জীবনে সোনার হরফে লেখা থাকবে। সেই ছবির সূত্র ধরেই পরিচয় তখনকার ভারতের শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের কোচ হারুনুর রশিদের সঙ্গে। তার পরামর্শে এরপরই একটা দল দাঁড় করানোর কথা ভাবতে থাকেন।

মোহাম্মদ মহসিন জানাচ্ছিলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের কোন ক্রিকেট দল আছে কিনা সেটা তখনো জানতাম না আমি। সেটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে যোগাযোগ করি সেন্টার ফর রিহ্যাবিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজডের (সিআরজি) প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালরি টেলরের সঙ্গে। তার উৎসাহে একটা দল গড়ার চিন্তা মগজে স্থায়ী হয়ে উঠে।’ 

হুইলচেয়ারে লাল-সবুজের প্রতিনিধি

তবে এতো কিছু করা সহজ ছিল না তার জন্য। এমনিতে নিজে প্রতিবন্ধী এক মানুষ। চলাফেরা করা ছিল কষ্টের। কতোবার যে বাসে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছেন। আবার তাকে কেউ তুলতেও চাইতো না। তার ওপর আর্থিক অবস্থাটাও ভাল নয়। ছোট একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান। তা থেকে যা আয়, তা দিয়ে সংসার চালানোটা তো মুশকিল। 

কিন্তু দমে যাননি তিনি। যোগাযোগ রাখতে থাকেন হারুনুর রশীদের সঙ্গে। তার কাছ থেকে জেনে নেন প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেটার আইন-কানুনের খুঁটিনাটি। এভাবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় কোচ হারুনুর রশীদ আসেন ঢাকায়। তিনি বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে খেলার প্রস্তাব দেন।

ভ্যালেরি টেলর রাজি হয়ে যান সেই প্রস্তাবে। তবে গোটা একটি দল এক সুতোয় গাঁথা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু উদ্যোমী মহসিন যখন আছেন তখন আর ভাবনা কি? ২০ জন প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়কে এক করে ফেলেন তিনি। সিআরপি কর্মী বুলবুলের অধীনে শুরু হয়ে ১৬ সদস্যের দলের অনুশীলন।

বলা হচ্ছিলো দলের নেতৃত্ব দেবেন হুইলচেয়ার নিয়ে খেলা মহসিন। ভারতীয় দলও এই নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল একাদশ গড়তে গিয়ে দেখা গেল দলে মহসিন নেই। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না তার ‘আমি রীতিমতো অবাক। একি হল। ব্যাপারটায় খোদ হারুনুর রশীদ অবাক হয়ে বলেন, তোমার হাত ধরে একটা দল হলো, অথচ সেই দলে তুমি নেই।’

মন ভাঙ্গলেও হাল ছাড়েননি মহসিন। তার পুরস্কারটাও মিলেছে। ২০১৪ সালে তার নেতৃত্বে ভারত সফরে যায় বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দল। সেখানে ভারতীয় ডিসাবল স্পোর্টিং সোসাইটির সঙ্গে দল খেলে ৩ ম্যাচ টি-টুয়েন্টি সিরিজ।

কিন্তু সেই সফরে যাওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। আর্থিক সমস্যাটা এমন হয়ে উঠেছিল যে মনে হচ্ছিল ভারত যাওয়া হবে না। কিন্তু জেদ এতোটাই চেপে বসেছিল যে শেষ পর্যন্ত পরিবারের অবলম্বন ফ্লেক্সি লোডের দোকানটা বিক্রি করে দেন তিনি। পাশাপাশি জনতা ব্যাংকের সে সময়ের এমডি ড. আবুল বারাকাত বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টাস এসোসিয়েশনও এগিয়ে আসে। এভাবেই ২০১৪ সালের জুনে ভারত সফরে যায় দল। তাজমহল সিরিজে ২-১ এ জিতে দেশে ফিরে মহসিনের বাংলাদেশ। এরপর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ডেকে নিয়ে সংবর্ধনা দেন গোটা দলকে।

তারপর অবশ্য পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছর আবার তার নেতৃত্বে দল যায় ভারতে। এমনকি বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিটি) সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। ইংল্যান্ডে শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের কোচ ইয়ান মার্টিনের নেওয়া ওয়ার্কশপে অংশ নেন।

কঠোর পরিশ্রম, অদম্য মানসিকতায় ধরা দেয় সাফল্য

অবশ্য তখনই জানতে পারেন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধীরা বোর্ডের অধীনে কোন জাতীয় দলে খেলতে পারবে না। কারণ তারা হঠাৎ ইনজুরিতে পড়লে খেলতে হবে একজন কমে। এই যুক্তিতে কাটা পড়ে তার নাম। অথচ হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী কোন প্রতিবন্ধী কেন খেলতে পারবেন না এমন সুনির্দিষ্ট আইন নেই বলে দাবি মহসিনের।

তবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের এই অগ্রদূত সেই একই আগ্রহ নিয়ে এখনো লড়ে যাচ্ছেন। ২৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল। এই তো কিছুদিন আগে পল্টনের হ্যান্ডবল মাঠে চার দল নিয়ে একটা টুর্নামেন্টও আয়োজন করলেন। সামনে নেপাল, ভারত, পাকিস্তানকে নিয়ে হবে চারদেশীয় এশিয়া কাপ। 

মনের খোরাক মিটিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ‘পাগলামি’তে জীবনের চাকা যে থমকে গেল প্রায়। মহসিন এখন একা নয়, স্ত্রী আর এক কন্যার দায়িত্বটাও তার কাঁধে। কিন্তু ফ্লেক্সি লোডের দোকানে বিক্রির পর আয়ও যে বন্ধ। বাবার সহযোগিতায় কোন রকমে দুমুঠো খাবার জুটছে।  

যেখানে মাশরাফি-মুশফিক-সাকিবরা স্বচ্ছল জীবন যাপন করছেন সেখানে আরেক টাইগার ক্রিকেটারের জীবনটা একেবারেই ছন্ন ছাড়া, ‘কণ্যার মুখটির দিকে তাকালে কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসে, বিশ্বাস করুন মেয়েটার শখ কোনটাই তেমন করে পূরণ করতে পারিনি। আমি তো টাকার পেছনে ছুটিনি। চেয়েছিলাম যারা সমাজের চোখে শুধু করুণার পাত্র তাদের নিয়ে কিছু করতে। তবে আমার নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছি হতাশার কিছু নেই। প্রতিবন্ধীদেরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। আমরা অন্যের দয়ার পাত্র কেন হবো? ভিক্ষাভিত্তিতে কেন যাবো আমরা।‘

সমাজ, রাস্ট্রের দ্বায়িত্বটুকুও মনে করিয়ে দিলেন মহসিন, ‘দেখুন, দেশের জন্য আমরাও তো কিছু না কিছু করছি। মুশফিক-মাশরাফিদের মতো আমরাও তো লাল-সবুজের হয়েই লড়ছি। তাহলে আমাদের ঘরে সন্তানরা কেন থাকবে অনাহারে-অর্ধাহারে? তাহলে আমরা কেন বঞ্চিত হবো? মহসিনের এই প্রশ্নের উত্তরটা তোলা থাকলো কর্তা ব্যক্তিদের জন্য। 

দুটো পায়ে চলার শক্তি নেই, তারপরও যে মানুষটি হাল ছাড়েনি, তিনি নিশ্চয়ই পাওয়া-না পাওয়ার জটিল অংক মেলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন না। লাভ-ক্ষতির হিসাব জানলে কি আর দৃষ্টিভঙ্গি আর সমাজ বদলানোর নায়ক হয়ে উঠা যায়? শত বাধা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে মনের পাখা দিয়ে উড়তে শেখা মহসিনকে স্যালুট।

এমএইচ/এটি