স্বপ্ন পূরণের সেই দিন, ধরা দিয়েছে আইসিসি ট্রফি। কিলাত ক্লাব মাঠে উইনিং ল্যাপ আকরাম খানদের

১৩ এপ্রিল, ১৯৯৭। কী এক রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। সবেধন নীলমণি বাংলাদেশ বেতারে তখন চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাতের কন্ঠস্বর। ইথারে ভেসে আসা তার ধারাভাষ্যে তখন বুঁদ গোটা বাংলাদেশ। বলে বলে বর্ণনা। বল-রানের হিসাব। দুশ্চিন্তায় কেউ কেউ ঘেমে একাকার! সমীকরণ মেলাতে পারবে তো কিলাত কিলাব মাঠের ওই এগারোজন? বাংলাদেশ নামের উর্বর বদ্বীপে সেদিন কী বয়ে গেছে তা বোঝাতে হাজারো শব্দও যেন অসহায়।

জিততে শেষ ওভারে চাই ১১ রান। বল হাতে কেনিয়ান পেসার মার্টিন সুজি। উইকেটে খালেদ মাসুদ পাইলট ও হাসিবুল হোসেন শান্ত। উত্তেজনার পারদ আকাশ ছুঁয়ে যায় শেষ ৬ বলে। মার্টিন সুজির বলে শেষ বলে চাই এক রান। স্ট্রাইকে শান্ত। মাথা নিচু করে ব্যাট চালালেন। বল পায়ে লাগতেই রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দু'জনের। যেন পপিং ক্রিজ পার হতে পারলেই মিলবে রাজ্য, রাজত্ব সব! আসলেই তো তাই!

দিনভর উৎকন্ঠা শেষে চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাত যখন তার নাটকীয় দরাজ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠলেন ‘এবং বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭ সালের চ্যাম্পিয়ন’, ব্যস, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া তখন উত্তাল। সেবারই প্রথম বাঘের গর্জন শুনেছিল বিশ্ব। 

দর্শকরাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণ

৯৭ 'এর আইসিসি ট্রফি গোটা বাংলাদেশকে গেঁথেছিল বিনি সুতোর মালায়। লাল-সবুজের দেশ একজোট হয়ে সামিল হয়েছিল এই আনন্দ মিছিলে। ৭১'র মহান স্বাধীনতার এই প্রথমবারের মতো পুরো জাতি কোন একটা সাফল্যের আনন্দে সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পালন করে। ক্রিকেটই ঘুঁচিয়ে দিয়েছিল সকল ভেদাভেদ। রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে এক হয়ে গিয়েছিল দেশ।

সেই শুরু। তারপর আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে ক্রিকেটের জয় মানেই শাহবাগে, পাড়া মহল্লায় আনন্দ মিছিল। টিএসসিতে রঙ উৎসব। এভাবেই জাতীয় জীবনের একটা অনুষঙ্গ হয়ে উঠে ক্রিকেট। ক্রিকেটাররা জিতলে জিতে যায় বাংলাদেশ। তারা হারলে মলিন হয়ে যায় মায়ের মুখ। তুমুল তর্কের ঝড় ওঠে চায়ের দোকানে।

সেই আইসিসি ট্রফিই বিশ্বকাপের মঞ্চে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে। যোগ হয় বড় দলগুলোকে হারানোর আনন্দ। পাকিস্তানকে হারানোর সুখস্মৃতি আজও আলোড়িত করে ক্রিকেটপ্রেমীদের। আকরাম খান-আমিনুল ইসলাম বুলবুলদের পর মোহাম্মদ আশরাফুল-মাশরাফি বিন মর্তুজাদের আগমন ধ্বনিতে জেগে উঠে বাংলাদেশ। তারপর অবশ্য উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ।

১০ নভেম্বর, ২০০০ সাল। টেস্ট অভিষেক। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ ভারত। তার পথ ধরেই ১০ জানুয়ারি ২০০৫, প্রথম টেস্ট জয়। ম্যাচের পর ম্যাচ হার কিংবা ড্রয়ের আক্ষেপ শেষে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল কাঙ্ক্ষিত সেই জয়ের দেখা। পাঁচ বছর দুই মাস, ৩১ হার, ৩টি ড্র আর অনেক প্রতীক্ষার আরাধ্য জয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়!

আইসিসি ট্রফি হাতে আকরাম খান, সেদিনই নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ ক্রিকেট

লাল-সবুজের প্রায় পঞ্চাশ বছরের ক্রিকেট সংস্কৃতি। তবুও এই জয়টা যেন আলাদা, অন্যরকম। বাংলাদেশ একাধিক ম্যাচ জিতেছে আগে-পরে, ট্রফিও এসেছে অনেক। কিন্তু বিশ্বজয়? এটা তো সত্যিকার অর্থেই সোনার হরিণ। যেটা সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশের যুবাদের কল্যাণে। ভারতকে হারিয়ে পচেফস্ট্রুমে আকবর আলির হাত ধরে লেখা হয় নতুন এক ইতিহাস। অনেক বেদনার দুই হাজার বিশ সালে আইসিসি অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতে জুনিয়র টাইগাররা। এটি দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন বলেন অনেকেই।

পথচলায় বাংলাদেশ পেয়েছে অসাধারণ সব প্রতিভা। সাকিব আল হাসান, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজা, হয়ে উঠেছেন সবার নেতা । তামিম ইকবাল, ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের ট্রেডমার্ক । মুশফিকুর রহিম, সবার আদর্শ হয়ে গেছেন আগেই। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান মুগ্ধ করেছেন বোলিং কারিশমায়। একের পর এক তারকার জন্মে নতুন উচ্চতায় পা রেখেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রভাবী এবং ব্র্যান্ড নামটা হয়ে গেলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। দেশের বাইরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তিনিই। যে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন, নিশ্চিত করেই শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সেরাদের একজন হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করবেন তিনি।

আকরাম, বুলবুল, মাশরাফি সাকিবদের হাত ধরেই তো ক্রিকেট এখন অনন্য উচ্চতায়। জাতীয় খেলা কাবাডি কিন্তু ক্রিকেট হয়ে গেল দেশের নাম্বার ওয়ান খেলা। এখন তো অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ছক থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তারা এখন সন্তানকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন দেখেন। মা তার পুত্রকে নিয়ে ছুটে যান অনুশীলনে, কোচিং ক্যাম্পে। ছেলে সাকিব কিংবা মুশফিক হোক সেই স্বপ্নে বিভোর থাকেন মা-বাবা!

সত্যিকার অর্থে ক্রিকেট এখন শুধু একটা খেলাই নয়, স্ট্যাস্টাস সিম্বল। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন মান ধারনের জন্য অন্যতম একটা পেশা। গত বিশ্বকাপে ক্রিকেটের সাফল্য দেশের মানুষকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। এক অর্থে ক্রিকেট ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে বড় প্রভাবক হয়ে পড়েছে। ক্রিকেট এখন নেহাত মাঠের খেলাই নয়, দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের একটা অংশও বটে।

দেশের ক্রিকেটকে পথ দেখিয়েছেন সাবের হোসেনের মতো সংগঠকরাও

তবে ক্রিকেট যেমন আনন্দ দিয়েছে তেমনি দুঃখ- বেদনাও কম দেয়নি। ম্যাচ ফিক্সিং, মাঠে কানাডা- কেনিয়া-আফগানিস্তানের মতো দলের কাছে হার। শেষ ওভারে নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হেরে আসা। ২০ বছর টেস্ট খেলার পরও এখনো সেই তলানিতে পড়ে থাকা। আনন্দ যেমন দিয়েছে ক্রিকেট, তেমনি যন্ত্রণা-হতাশাও কম দেয়নি। এই বাঁকবদল। এই উপর-নিচ। এই উত্থান-পতন সবকিছুই জীবনের নিয়মের সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যাচ্ছে।

তবে একটা হাহাকার নিশ্চয়ই ক্রিকেটারদেরও উথাল পাতাল করে দেয়। ওপার বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতা যেমন গেয়েছিলেন, ‘জিতে গেলে হিপ হিপ হুররে শুনবে তুমি হেরে গেলেই শেম শেম ইটস এ গেম!’ জিতলে পরিকল্পনা সঠিক, হারলে সব শেষ, গভীর সাগরে পড়লেন তা কিন্তু ঠিক নয়। এই সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। এই নিয়মেই জীবন চলে। ক্রিকেটও তাই। আমাদের আনন্দ-বেদনার সহযাত্রী এখন ক্রিকেট।

সাদা-কালো সেই বোকা বাক্সের দিনগুলোতে হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এইসব দিনরাত্রি। যেখানে পর্ব শেষে বলা কথাগুলো একটু পাল্টে দিলেই আমাদের ক্রিকেটের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। আশা ও আনন্দের যে অপরূপ দিন, তার উল্টো পিঠেই দুঃখ ও বেদনার দীর্ঘ রজনী... আশা-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা নিয়েই আমাদের এইসব আনন্দ-বেদনার ক্রিকেটের দিন-রাত্রি।