ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখার জন্য আজ ৮৫ জন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। এদের মধ্যে ড. শেখ আব্দুস সালাম একটু ব্যতিক্রম। বাকিরা যেখানে পুরোদস্তুর খেলোয়াড়, সংগঠকই মূল পরিচয় সেখানে সালামের পরিচিতি মূলত শিক্ষক হিসেবে। অধ্যাপনার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনেও অবদান রেখে সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন সালাম।

শেখ আব্দুস সালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। এখন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশিষ্ট এই শিক্ষক ক্রীড়াঙ্গনে একটি অপ্রচলিত খেলা ক্যারম নিয়ে কাজ করেছেন। ক্যারম ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। একটানা ১৬ বছরের বেশি সময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ফুটবল, ক্রিকেট,দাবার মতো জনপ্রিয় খেলা থাকতে ক্যারমে মনোযোগ দেয়ার কারণ সম্পর্কে সালাম বলেন, ‘ক্যারম কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। বাসা-বাড়ি, পাড়া-মহল্লায় খেলা হয়। এই খেলাগুলো হতো আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ না করে এবং ক্যারমের কোনো সংগঠনও ছিল না। সেই তাগিদ থেকে আমি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে খেলানোর চেষ্টা করি এবং একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে আন্তর্জাতিক মর্যাদার লক্ষ্যে ফেডারেশন প্রতিষ্টা করি।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দাবা ও ক্যারম প্রতিযোগিতার দায়িত্বে থাকতেন তিনি। ১৯৯০ সালের দিকে ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করার পর ঢাকায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ও দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুরু হয়। ক্যারমের মাধ্যমেও বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে শুরু করে। 

‘১৯৯৫ সালে পঞ্চম সার্ক টুর্নামেন্ট ঢাকায় আয়োজন করি। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে আমরা ভারতকে হারিয়েছিলাম। যেখানে ভারতে ক্যারমের ইতিহাস ছিল তখন অর্ধ শতাব্দীর মতো আর আমাদের মাত্র বছর পাঁচেক। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে এশিয়ান ও বৈশ্বিক পর্যায়েও আমাদের সাফল্য রয়েছে’-বলেন ফেডারেশনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

ক্যারমের মাধ্যমে অনেক তরুণের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করেছেন সালাম। প্রথম জাতীয় ক্যারমের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অত্যন্ত নিম্নআয়শ্রেণীর একজন। ক্যারমে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তার সামাজিক মর্যাদা বেড়েছিল এবং পেশাগত অবস্থার পরিবর্তনও হয়েছিল। এ রকম ঘটনাও রয়েছে অনেক।

এক যুগের মধ্যে ক্যারমকে প্রতিষ্ঠা করলেও ২০০৭ সালের দিকে হঠাৎ একদিন দেখেন তিনি আর ফেডারেশনের সভাপতি নেই, জানান সালাম। এরপর সালামের ক্রীড়া সংগঠক জীবন ভিন্ন এক মোড় নেয়। প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।

প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট এসোসিয়েশন ফর ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জড এর প্রতিষ্টা করেন এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ক্যারমের মতো এখানেও নিজেকে সফল সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সাকিব-তামিমদের মতো বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফলতা বয়ে আনেন। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ত্রিদেশীয় প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের পাশাপাশি প্যারা অলিম্পিকেও ভূমিকা রেখেছেন।

অধ্যাপনার পাশাপাশি ক্যারম ও প্রতিবন্ধী ক্রিকেট নিয়ে কাজ করায় সালামকে ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। এক অঙ্গনের ব্যক্তি হয়ে আরেক অঙ্গনের সর্বোচ্চ পদক পাওয়ার পর সালামের প্রতিক্রিয়া, ‘আমি খেলাধূলার ভালোবাসা থেকেই এগুলো করেছি, কোনো পদক বা স্বীকৃতির জন্য নয়। সরকার আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ও অবদানকে মূল্যায়ন করেছে এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

ক্রীড়াঙ্গনে সময় দিলেও তার মূল পেশা শিক্ষকতায় কখনো সময় কম দেননি, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগের কোনো ছাত্র-ছাত্রী বলতে পারবে না স্যার ক্লাসে দেরি করে এসেছে। আমি সময়ের ক্ষেত্রে সব সময় নিষ্ঠাবান।’

আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক খেলোয়াড় আসত। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটা নেই। আবার অনেক মেধাবী সাধারণ শিক্ষার্থী খেলাধূলায় আসতে চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও শিক্ষকদের নমনীয়তা না থাকায় আর ক্রীড়াঙ্গনে আসা হচ্ছে না। 

দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে ক্রীড়ার প্রতি তার বিশেষ নজর রয়েছে, ‘কুস্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটা রয়েছে। পাশাপাশি খেলোয়াড়দের বিশ্ববিদ্যালয় পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করা হয়।’ 

একজন শিক্ষাবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সালামের স্বপ্ন অনেক বড়, ‘দেশে যেমন বিকেএসপি রয়েছে তেমনি আশা করি একদিন ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় হবে। যেখানে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক খেলোয়াড়, ক্রীড়া গবেষক পড়তে আসবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রীড়া শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। আশা করি ভবিষ্যতে সামনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া বিভাগ এবং আলাদা একটি ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় হবে।’