নিজেকে আড়ালে রাখতেই ভালোবাসেন তিনি। হাঁক-ডাক নেই, নিরবে শুধু কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের ভাষায় তিনি ‘অন্তর্মুখী’! সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ডাইনিং রুমে বসে কথা বলতে গিয়ে তাই মনে হয়েছে। লাজুক হাসিতে বললেন, ‘আমি ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। ক্যামেরার সামনে ফর্মাল কথা তো নয়ই!’

কবি কুসুম কুমারী দাসের সেই কবিতার আকুতি, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ সেই অপূর্ণতাটা যেন পূরণ করে দিয়েছেন মাসুদ রানা। যে কোন বাংলাদেশি গর্ব করতে পারেন তাকে নিয়ে। এই যে অস্ট্রেলিয়ার  মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বড় আয়োজন নির্বিঘ্নে হচ্ছে তাতে একটা বড় অবদান আছে এই বাংলাদেশি যুবকের। আরেকটু সরাসরিই বলা যায় বিখ্যাত সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মাসুদ রানা।

সিডনিতে আসার আগেই এই মানুষটার সম্পর্কে টুকটাক শুনেছিলাম। ইচ্ছে ছিল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে গিয়েই কথা বলবো। কিন্তু যেমনটা শুরুতে বলেছি-কথায় নয়, কাজেই বেশি পারদর্শী তিনি। তারপরও যখন মুখোমুখি হলাম-মাসুদ রানা বলছিলেন, ‘ভাই আমি খুব ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। সামনে তেমন আসতে চাই না। অথবা পারি না।’

কিন্তু তিনি না চাইলে কী হবে, তার কাজই বারবার তাকে নিয়ে আসে প্রথম সারিতে। মাসুদ রানা এখন কাজ কাজ করছেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড আর পাশের ফুটবল স্টেডিয়ামে। যেমনটা বলছিলেন তিনি, ‘এখানে সিডনি ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও ফুটবল স্টেডিয়াম দুটোর আইটি নেটওয়ার্কের দায়িত্বে আছি আমি। নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার বলতে পারেন।’ পুরো মাঠ এমনকি প্রেসবক্সের ওয়াইফাই লাইনসহ আইটির বাকিসব কাজও সামলাতে হয় তাকে।

বিশ্বকাপের মাস দুয়েক আগে জড়িয়েছেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সঙ্গে। শুধু ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার টানে এই চাকরিটা বেছে নিয়েছেন মাসুদ রানা। এর আগে অস্ট্রেলিয়া স্টেট গভর্নমেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন।

তবে তার শিকড় পড়ে আছে বাংলাদেশের জেলা পাবনায়। সেখানেই জন্ম মাসুদ রানার। নিজের পরিচয়টা দিতে গিয়ে আরও বলছিলেন, ‘প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি আমি, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তার আগে পাবনার সাগরকান্দি হাইস্কুলে পড়া। এরপর কলেজ জীবন পাবনায়। তারপর বুয়েটে ভর্তি হয়ে ঢাকায় আসা।’ কম কথায় এভাবেই কথা সেরে নিলেন মাসুদ।

তবে পড়াশোনা শেষ হতেই দেশের বাইরে আসেন নি। বলছিলেন, ‘পেশাদার ক্যারিয়ারে শুরুতে কাজ করি গ্রামীণফোনে। সেখানে ছিলাম ১০ বছর। তারপর যেহেতু টেকনিক্যাল দেশের বাইরেও সুযোগ এসেছে। অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে ইরানে কনসলিটেন্সি করেছি।  ইরানের সরকারি মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে তিন বছর ছিলাম। অবশ্য ইরানে যাওয়ার আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ায় আসবো।’

এখন তো চার বছর ধরে তাসমান পাড়ের দেশেই আছেন মাসুদ। দেশ থেকে অনেক অনেক দূরে থাকলেও দেশপ্রেম আগের মতোই তার। এমনকি খোঁজ রাখেন সাকিব আল হাসানদের। দলটা নিয়ে আশাবাদীও তিনি। মাসুদ বলছিলেন, ‘আমার যেটা মনে হয়েছে আমাদের ক্রিকেট দলটা একটু পুননির্মাণের পথে আছে। সিনিয়র অনেকেই সরে গেছেন। যেমনটা বলা হয় পঞ্চপান্ডব তাদের মধ্যে টি-টোয়েন্টি দলটাতে শুধু আছেন সাকিব। আমার মনে হয় যারা আছে তাদের সময় দিতে হবে। দেখুন সাকিবও কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে গেছে।’

মাসুদ আরও যোগ করলেন, ‘দেখুন, আমি হতাশ নই। আমাদের আফিফ আছেন। লিটন দাস আছেন। তারা নিজেকে প্রমান করে যাচ্ছেন। তাসকিন এখন ওয়াল্ড ক্লাস মানের। যোগ্য প্লেয়ার। মুস্তাফিজের খারাপ সময় যাচ্ছে কিন্তু ওর কোয়ালিটি আছে। আমি মনে করি এরা ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে। শ্রীলঙ্কা খারাপ সময় কাটিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে। আমরাও একটা সময় পারবো।’

সেই দিনেরই স্বপ্ন বুঁনছেন মাসুদ। তার বিশ্বাস সাকিবরা এগিয়ে যাবেই। কথাগুলো বলতে গিয়ে কোথায় যেন একটু উদাসও মনে হলো তাকে। জানতে চাইলাম-নিজে কখনো ক্রিকেট খেলেছেন? 

হাসিমুখে সিডনি মাঠের মাসুদ রানার উত্তর, ‘বুয়েটে পড়ার সময় অবশ্য তেমন খেলা হয়নি। তবে গ্রামে খেলেছি। এখানে অস্ট্রেলিয়ায় এসেও খেলছি। যেখানে থাকি সেই ওয়েস্টার্ন সিটিতে প্রতি রোববার ক্রিকেট খেলি। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। কাজের ফাঁকে রোববার ছুটির দিনে খেলি। দেখুন ক্রিকেটের টানেই তো এখানে আসা। আমি হয়তো খেলবো না কিন্তু এখানে ক্রিকেটারদের আশপাশে থাকিবে। ক্রিকেট নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকেন তাদের সঙ্গে সময় কাটাবো। তাদের জন্য কাজ করবো। এটা দারুণ ব্যাপার।’

এভাবেই ক্রিকেট ক্রিকেটপ্রেমী মাসুদ রানা খুঁজে নেন স্বস্তি। ক্রিকেটার হতে পারেন নি। কিন্তু ক্রিকেটেই আছেন। বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে পাবনার এই যুবক এখন সিডনি স্টেডিয়ামের সফল আয়োজনের অন্যতম রূপকারও!

এটি/এনইউ