শহরে পা দিয়ে আমরা যেখানে উঠেছি, সেই স্নোডেন স্ট্রিট অনেকটা গ্রামের মতো। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কোন গ্রামে চলে এসেছি। ভোর হতেই কাক ডাকছে, পাখির কিচির মিচির শব্দও চারপাশে, গাছপালা চারপাশে শান্ত নিরিবিলি। শুধু এখানটা জনশূন্য, বাংলাদেশ জনারণ্য! যার প্রতিবেশী হয়েছি সেই তরুণ আবার মাস ছয়েক হয়েছে ব্রিসবেনে এসেছেন। রাহুল কর ও মোহাম্মদ মামুন প্রায় দশ বছর হলো আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতেই ছিলেন প্রবাসী জীবনের প্রায় পুরোটাতে। খানিকটা ভাল থাকার প্রলোভনে সিডনি ছেড়ে এসেছেন এই শহরে। কিন্তু বছর যাওয়ার আগেই ঠিক করে ফেলেছেন এখানে আর নয়! কিছুদিন পরই ফের উড়ে যাবেন সিডনিতেই!

আসলে অভিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম দুই পছন্দের শহর সিডনি আর মেলবোর্ন! স্থায়ীভাবে বসবাসের কথা ভাবলে ওই দুটো শহরকেই সবার আগে ভাবেন তারা। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার শহরগুলো তেমন টানেনা বাংলাদেশিদের। এর অনেক কারণের একটি হতে পারে কর্ম সংস্থান, সুযোগ সুবিধা। তবে সেটাও পাল্টে যাচ্ছে একটু একটু করে। এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটিও বড় হচ্ছে!

তবে সেদিন ব্রিসবেনের গ্যাবা স্টেডিয়াম থেকে ফেরার হাঁটা পথে একটা নাম দেখে থমকে গিয়েছিলাম। স্ট্যানলি স্ট্রিটের রাস্তার ঠিক পাশেই একটা রেস্টুরেন্টের নামে চোখ আটকে গেল-বেঙ্গল কিচেন! দুপুর গড়িয়েছে, ক্ষুধার্তও ছিলাম আমরা ৫জন। সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকের শামীম হামিদ, আমাদের সময়ের মাইদুল বাবু, এখন টিভির হুমায়ুন কবির রোজ আর সংবাদের ইদ্রিস আলি। ব্যস, রেস্টুরেন্টে পা রাখতেই ইনটেরিয়র দেখে তো মুগ্ধতা বেড়ে গেল আরও!

তবে শুরুতেই ভুরি ভোজ। কথা বলতেই মাঝ বয়সী একজন ছুটে এলেন। যদিও তখন দুপুরের খাবারের সময় শেষ। রাতে আবার এই রেস্টুরেন্টেই বড় একটা আয়োজন। তারপরও বাংলাদেশি শুনে দেরি করলেন না-দ্রুত মাংস, ডাল, সবজি হাজির করলেন সামনে। একেবারে বাঙালিয়ানা স্বাদ! আপ্যায়নে আন্তরিকতায় তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম-তখন ঘুরে ঘুরে রেস্টুরেন্টটি দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না!

চারপাশ জুড়ে শুধু বাংলাদেশি তারকাদের ছবি। যেখানে ক্রিকেটের মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে শুরু করে বিদোদন জগতের তারকারাও আছেন। আর পুরো ইনটেরিয়রে বাংলাদেশ আর দেশপ্রেমের ছাপ। কোথাও জাতীয় পতাকা কোথাও আবার লাল-সবুজের মিশেল। সব মিলিয়ে দেশের বাইরে সুদুর ব্রিসবেনে এমন একটা পরিবেশ পেয়ে যাবো ভাবতেও পারিনি। তবে এটুকু তখন বুঝে গিয়েছি এই রেস্টুরেন্টের মালিক একজন বাংলাদেশি।

ব্যস, কিচেনে ঢু মারতেই পরিচয় হয়ে গেল মানুষটির সঙ্গে। তিনি মোহাম্মদ রাজু। স্ত্রী-কে সঙ্গে নিয়ে চালাচ্ছেন এই রেস্টুরেন্ট। সঙ্গে দু-তিন স্টাফও আছেন। কীভাবে দেশের বাইরে এসে এভাবে এমন একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসলেন তিনি? আর কেনই বা থিম হিসেবে বাংলাদেশকেই বেছে নিলেন?

ব্রিসবেনের তুমুল জনপ্রিয় বেঙ্গল কিচেনের কর্ণধার বলছিলেন, ‘৩১ বছর ধরে আমি আছি অস্ট্রেলিয়ায়। পড়াশোনা করতে এখানে এসেছিলাম। ১৯৯১ সালে এখানে এসেছে আট-নয় বছর পড়াশোনা করেছি। যদি চাইতাম ইচ্ছে করলে ভাল কোন চাকরি খুঁজে নিতে পারতাম। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল এখানে একটা রেস্টুরেন্ট খুলব। বাংলা খাবার পরিবেশন করবো। বাংলা নাম রাখবো। অস্ট্রেলিয়ার যারা স্থানীয় আছে তারা বাংলা খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।’

ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ছেলে রাজু নিজের সেই পথচলার গল্পটা জানাচ্ছিলেন এভাবে, ‘এখানে দেখা যায় বেশির ভাগই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। বাংলা রেস্টুরেন্ট নেই। আমি এটি ২০১২ সালে শুরু করেছি। তারপর থেকে আমাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এখানে এই ব্রিসবেনে বাংলাদেশ থেকে যারাই এসেছেন খেলোয়াড়, শিল্পী, সচিব সব বাঙালিরাই এখানে আসেন।’

তবে এরচেয়েও চমকপ্রদ যে খবরটা দিলেন মোহাম্মদ রাজু তা হলো সাকিব আল হাসান-তাসকিন আহমেদেরও প্রিয় রেস্টুরেন্ট এটি। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে এসেও এখানকার খাবার আয়েশ করে খেয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। 

রাজু বলছিলেন, ‘গেল সপ্তাহ সাকিব আল হাসান তার পুরো দল নিয়ে এখানে এসেছিলেন। ওরা আমার খাবারটা খুব পছন্দ করে।’ সঙ্গে যোগ করলেন কী ছিল সাকিব আল হাসানদের মেন্যুতে, গরুর মাংস, চিকেন কারি, ভাত, আলু ভর্তা আর ডাল। লিটন দাস আর সৌম্য সরকারের জন্য ছিল খাশির মাংস। একদিন হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলাম খাবার। পরে গ্যাবাতে অনুশীলন শেষে খুব ক্ষুদার্ত ছিলেন ওরা। এখানে এসে মজা করে ভাত-মাছ খেয়েছেন।'

সঙ্গে জানালেন আগেও এখানে খাবার খেতে এসেছেন ক্রিকেটাররা। যতোটুকু মনে পড়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল এসেছিল। যখন এনামুল হক বিজয় তার দল নিয়ে এসেছিল। এরপর ২০১৫ সালে মাশরাফিও এসেছেন। তারা তিন-চারবার এখানে এসেছে। তারা বাঙালি খাবার পছন্দ করেন, এজন্য খাবার রান্না করে আমি তাদের জন্য নিয়ে যেতাম। 

বাঙালিদের মধ্যে তো দারুণ সাড়া মিলেছেই, এখানকার অজিদেরও টেনেছে এই খাবার। রাজু বলছিলেন, ‘দেখুন, আজ থেকে যদি ১৫ বছর আগের কথাও বলি তখন বাঙালি খাবার স্থানীয়রা ভয় পেতো। কারণ স্পাইসি। কিন্তু গত অর্ধ যুগ ধরে এই ব্যাপারটা পাল্টেছে। এখন অনেকেই আছেন এসে বাংলা খাবার খোঁজ করেন। খাশির মাংস, গরু, চিকেন আর ভেজিটেবল খেতে চান।’ 

সবাই যখন এই রেস্টুরেন্টে এসে তৃপ্তি নিয়ে খাবার খান তখন খুব ভালো লাগে রাজুর। দেশের বাইরে বসে তখন মনে হয় যেন দেশের জন্যও কিছু করতে পেরেছেন, ‘আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ছোটকাল থেকেই আমরা দেশকে ভালবাসতাম। ফুটবল খেলতাম। তখন স্বপ্ন ছিল একদিন বড় খেলোয়াড় হবো। ভাগ্য সহায়তা করেনি, তাই খেলোয়াড় হতে পারিনি। এখন খেলোয়াড়দের যখন খাবারটা পরিবেশন করতে পারি, তখন কী যে ভাল লাগে!’

কথাটা বলেই অন্যরকম এক তৃপ্তির হাসি রাজুর মুখে। তবে দম ফেলার সময় নেই তার। কিছুক্ষণ পরই ডিনার টাইম। সবাইকে বাংলা খাবারে মুগ্ধ যে করতেই হবে! এটা যে বাংলাদেশের সুনাম বলে কথা!

এটি/এনইউ