সেই ছোটবেলা থেকেই টেনিসের পোকা। বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্লামকে মনে হতো স্কুলের প্রথম দিনের মতো নতুন। কী যে এক ভাললাগা জড়িয়ে ছিল! আহা, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন নামটার সঙ্গে অদ্ভুত একটা রোমান্টিসিজম লেগে আছে। সঙ্গে ইয়ারা নদীর স্বচ্ছ জল আর রড লেভার অ্যারেনা, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশন- সব যেন না দেখলেও মুখস্থ হয়ে আছে। মঙ্গলবার যখন পা রেখেছি সেই মায়ার শহরে তখনো সকালের আলো ফোটেনি। পুবের আকাশে কেমন যেন রক্তাভ আভা!

ফ্রাঙ্কলিন স্ট্রিটের অ্যাডিলেড স্টেশন থেকে গাড়িতে উঠেছিলাম আগের দিন রাত সোয়া আটটায়। তারপর ফেয়ার ফ্লাইয়ের জার্নি বাই বাসে কখন যে একটা রাত মহাসড়কের বুকে চলে গেল, টেরই পেলাম না! মেলবোর্নের স্পেন্সার স্ট্রিটের সাউদার্ন ক্রস বাস স্টেশনে নেমে দেখি মহাব্যস্ত এই শহর। সবাই ছুটোছুটি করছেন- একটা কর্মব্যস্ত দিন শুরু হলো বুঝি।

আমিও দ্রুত মেট্রো ধরব বলে ছুটলাম। অবশ্য পুরো অস্ট্রেলিয়ার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমটাই এমন- একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া। একটা থেকে আরেকটাতে যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। তবে বিপত্তি বাঁধল মেট্রোতে ওঠার পাশ নিতে গিয়ে। এখানে প্রতিটা রাজ্যে আলাদা আলাদা নিয়ম, যেন আলাদা সব দেশ। ট্রান্সপোর্ট কার্ডও আলাদা। সিডনির ওপাল কার্ড মেলবোর্নে কাজে লাগার প্রশ্নই আসে না।

মেলবোর্নের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার সেই কার্ড সাড়ে সাতটার আগে সংগ্রহের সুযোগ নেই। তার আগে দরজা বন্ধ! ব্যস, মিনিট ত্রিশেক প্লাটফর্মে বসেই দেখলাম সকালের চাঞ্চল্য। যেমনটা বলছিলাম, ছুটোছুটি চারদিকে। বুঝতে বাকি রইল না এখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে সবকিছু।

বয়সী এক নারী এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন কী চাইছি। তাকে বলতেই মুশকিল আসান। পিটি-মাইকি কার্ড পেতে জমা দিতে হলো ৬ ডলার। সঙ্গে ৪৪ ডলার রিচার্জ। আমার গন্তব্য বারউইক। কোথা থেকে উঠব জেনে নিয়ে চলে গেলাম ১২ নম্বর প্লাটফর্মে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম ট্রেনটা মিস হয়ে গেল! কী আর করা। ফের ১০ মিনিটের অপেক্ষা। ১০ মিনিট পর শুরু হলো মেলবোর্নের মেট্রোতে প্রথম যাত্রা। ব্যস, চোখের সামনে একের পর এক খুলে গেল কাগজে পড়া সেই স্মৃতির ঝাঁপি। সেই বিখ্যাত ফিল্ডারস স্ট্রিট, ইয়ারা নদীর নাম জড়িয়ে আরও কিছু স্টেশন।

ভোরের আলো ফুটেছে, শীত শেষে অস্ট্রেলিয়ায় গরম পড়তে শুরু করেছে। আমার চোখ তখন বাইরে- রঙিন গ্রাফিতির ছোঁয়ায় উজ্জ্বল লেনওয়ে, রাস্তার পাশের দেয়াল। এটাও একটা বড় বৈশিষ্ট্য হয়তো মেলবোর্নের। নানা রঙের সব নকশা মেট্রোর পাশের দেয়ালগুলোতে।

এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছি শহরটির ইতিহাসের কথা। মেলবোর্নকে চিনতে হলে যেতে হবে অনেক অনেক বছর আগে। শতাব্দী-প্রাচীন এক শহর এটি। একে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভিক্টোরিয়ার রাজধানী ও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ইয়ারা নদীর প্রবেশমুখে পোর্ট ফিলিপ বে এলাকায় এ শহর। জনসংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে মেলবোর্ন, সিডনির পরই। যদিও ঢাকা শহরের মতো এতটা জনবহুল তো নয়ই। ৯,৯৯০.৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জনসংখ্যা কোটিও স্পর্শ করেনি। অথচ ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের ঢাকায় জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি!

এ কারণেই হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধাই এখানে হাতের মুঠোয়! এমনিতে অস্ট্রেলিয়া দেশটাও বিশাল। বুঝতে চাইলে এই উদাহরণটা বেশ যুতসই- তাদের মূল ভূখণ্ড বায়ান্নটি বাংলাদেশের সমান। অথচ জনসংখ্যা তিন কোটিও হয়নি। 

যে শহরে পা রেখেছি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে, সেই মেলবোর্ন ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। সেই ১৮৩৫ সালের ৩০ আগস্ট এই শহরের পথচলা শুরু। বুঝতেই পারছেন প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো এই শহর। শহরের চারদিকেই ইয়ারা নদীর স্রোত বয়ে চলেছে। দ্রুতগতির ট্রেনে বসে অবশ্য প্রথম দিনে নদীটা দেখা হয়নি। 

তবে জগৎ বিখ্যাত ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট পার হতে গিয়ে ইয়ারা নদীর একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। এই স্টেশনের গল্পটা নিশ্চয়ই আরেকদিন হবে। কারণ, এটি যে কেবল মেলবোর্নের প্রতীক তা-ই নয়, ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম রেলস্টেশন। ১৬৬ বছর পেরিয়ে অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে ধারণ করেছে আধুনিকতাও। 

সকালের শান্ত আলোতে বাইরে চোখ রাখছিলাম। দেখছিলাম ভবনগুলোর বনেদি স্থাপত্যশৈলী। চারপাশে কোনো কোলাহল নেই, সবাই সবার মতো নিজেতে মগ্ন থেকে ছুটছে কাজে। কারও সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অবশ্য মিষ্টি একটা হাসি বিনিময় হচ্ছে! এই ভদ্রতাটুকু নাকি এখানকার মানুষদের সেই ছোটবেলা শেখানো হয়। মুখে হাসি রেখেই কথা বলে অজিরা। এখানে স্থায়ী হওয়ারাও এখন তাই করে।

আরেকটা ব্যাপার চলতি পথেই চোখে পড়ল- গোটা মেলবোর্ন শহরটাই এমন, অতীতকে যেমন ভুলে যায়নি আবার আধুনিকতাকেও অস্বীকার করছে না। এই যখন ভাবছি তখন রাস্তার পাশে চোখে পড়ছে নানা রঙের ক্যাফে। যদিও সাত-সকালে সেখানে ভিড় নেই, হয়তো খোলেওনি তখন। দ্রুত পায়ে সবাই ট্রেনে উঠছেন। কাউকে আবার দেখলাম সকালের নাশতাটা সেরে নিচ্ছেন মেট্রোতে বসেই। সময়ের সঙ্গে তো পাল্লা দেওয়া চাই। এখানে এই অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটা মিনিট হিসাব করে চলা যায়। কারণ, ঢাকার মতো জ্যামে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

এই যখন ভাবছি তখন পাকেনহামগামী ট্রেন দ্রুত ছুটছে, ঘড়ির কাঁটা ধরে। শহর ছাড়িয়ে কেমন যেন একটা গ্রামের বাতাস লাগতে শুরু করেছে। নয় বা দশটা স্টেশনের মতো পেরিয়ে শহরতলীর বেরউইকে পৌঁছাতে অবশ্য লেগে গেল প্রায় ঘণ্টা খানেক। এখানে উঠেছি ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়ার ডরমেটরিতে। ছবির মতো সাজানো চারপাশ। সবুজের মেলায় সেই ক্যাম্পাসের গল্পটা হবে আরেকদিন।

ভাল করেই বুঝতে পারছি মায়াবী মেলবোর্নে অনেক চমক বাকি। কত কী দেখার বাকি এখানে।

ক্রিকেটের রাজ্যে ইয়ারার শহরে ক্ষণিকের দীপ্তিতেই আপাতত মুগ্ধ। সামনে কী ঝলকানি অপেক্ষায় কে জানে!

এটি/এনইউ/জেএস