সাথিরা জাকির জেসি/ফাইল ছবি

মফস্বল থেকে উঠে এসে ভর্তি হয়েছেন বিকেএসপিতে, অ্যাডমিট কার্ড না পেয়েও। শুটিংয়ে ভর্তি হয়েও ছাড়তে পারেননি ক্রিকেটের নেশা। এরপর সাক্ষী হয়েছেন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল সৃষ্টির শুরুর ইতিহাসের। মাঝে পেয়েছেন ‘ছেলে’ তকমা, নানা কটু কথা ভেসে এসেছে চারপাশ থেকে। সাথিরা জাকির জেসি পাত্তা দেননি কিছুই। বাইশ গজের পাট চুকিয়ে জেসি হাতে নিয়েছেন মাইক্রোফোন। সামলাচ্ছেন স্বামী আর সংসারও। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঢাকা পোস্ট-এর ক্রীড়া সম্পাদক আপন তারিককে তিনি শুনিয়েছেন সেসব গল্প...

আপনি বড় হয়েছেন উত্তরাঞ্চলীয় জেলা লালমনিরহাটের পাটগ্রামে। সেই প্রান্তিক অঞ্চল থেকে উঠে আসা এতটা সহজ ছিল না। বিশেষ করে একজন নারীর জন্য। আপনার সেই সংগ্রামের গল্পটা শুনতে চাই...

আমি যখন খেলা শুরু করেছিলাম তখন বাংলাদেশের কোনো মেয়েই সেভাবে ক্রিকেট খেলার কথা ভাবতে পারত না। ২০০১ সালের কথা বলছি। তখন আমি বিকেএসপিতে আবেদন করি। সেই সময়টাতে সেখানে মেয়েদের ক্রিকেট ছিল না। তারা আমাকে কোনো অ্যাডমিট কার্ড পাঠায়নি। এ কারণেই পরীক্ষার দুদিন আগে আমি আমার আম্মাকে বললাম, চলো গিয়ে দেখি কী অবস্থা। তারপর সাভারের বিকেএসপিতে এসে শুনলাম, মেয়েদের ক্রিকেট তারা শুরু করেনি। তখন বাংলাদেশেই সেভাবে চর্চাটা শুরু হয়নি। সংগতভাবেই মনটা ভেঙে গেল। হাল ছাড়লাম না। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আপাতত আমি একটা স্পোর্টসের সঙ্গে থাকি, পরে যখন ক্রিকেট চালু হবে তখন সেটাতে চলে যাব। 

তারপর ভর্তির অনুমতি মিলল, কোন ইভেন্টে ভর্তি হলেন?

তখন আমি শ্যুটিংয়ে ভর্তি হয়ে যাই। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল ক্রিকেটে। শুক্রবার ছিল বন্ধের দিন। সেদিন ছুটে যেতাম ক্রিকেটে। ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়তাম। সত্যি বলতে কী আমার জন্যই তখন বিকেএসপিতে মেয়েদের জন্য ক্রিকেট চালু করা হলো। ২০০৭-এর দিকে এসএসসি দিয়ে আমি ঢাকায় চলে এলাম। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ক্রিকেট। তখনই ডিভিশন ক্রিকেট শুরু হয় ঢাকায়। তারপরই জাতীয় দলে সিলেক্ট হয়। প্রথম জাতীয় দলেই আমি খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। 

আপনি বলছিলেন, আপনার মা আপনাকে নিয়ে সাভারের বিকেএসপিতে চলে আসেন। আপনার মায়ের সম্পর্কে শুনতে চাই, যিনি সমাজের উল্টো স্রোতে গিয়ে এতটা প্রেরণা দিয়েছিলেন আপনাকে...

আমার মা প্রাইমারি স্কুলের হেড টিচার। এখনো তিনি শিক্ষকতা করছেন। আমার মা-ই আসলে পথ দেখিয়েছেন আমাকে। শুধু খেলা নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই তিনি নিয়ে যেতেন আমাকে। স্কুলে যখন খেলা হতো তখন সব পুরস্কার পেতাম। থানা পর্যায়ে যখন খেলতাম তখন অনেকেই মজা করে বলত, তোমার মা কি পুরস্কার নিতে বস্তা নিয়ে এসেছে? বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দশ-বারোটা পুরস্কার প্রায় সব সময়ই থাকত। আমার আম্মাই আসলে আমাকে এভাবে প্রস্তুত করেছেন। এমনকি আমার আব্বুও বেশ সহযোগিতা করেছেন। আমি তো লালমনিরহাট থেকে জানতাম না ঢাকায় একটা বিকেএসপি আছে। যেখানে শুধুমাত্র খেলাধুলা হয়। প্লেয়ার তৈরি হয়। আমার মা আমার পথটা তৈরি করে দিয়েছেন। আমার আম্মু তার নিজের ক্যারিয়ারেও দারুণ সফল।

আপনি পরিবার থেকে বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন। সবাই সেটা পায় না। বিশেষ করে এই সমাজে একজন নারীর জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথটা সহজ নয়। অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ক্রিকেটার হয়ে ওঠা কত কঠিন ছিল?

আমি যখন খেলার কথা চিন্তা করেছি, তখন কেউ চিন্তাই করত না যে একটা মেয়ে ক্রিকেট খেলবে। ঢাকার মেয়ে হয়তো চিন্তা করতে পারত। কিন্তু আমার মতো মফস্বলের একটা মেয়ের জন্য এটা ছিল ভাবনার অতীত। সব সময় মামা-চাচারা বলত, মেয়েকে কেন খেলতে দিয়েছ, কী হবে, এটার কোনো ফিউচার নেই। এর চেয়ে ভালো কলেজে দাও। ভালোভাবে পড়াশোনা করুক। আমি যেহেতু পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, এমনকি বিকেএসপিতেও। এজন্য সবাই বলত খেলা বাদ দিয়ে ওকে পড়তে বল। বাবা-মাকে এটার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আবার বাবা-মা বিরক্ত হয়ে মাঝে মধ্যে আমাকে কথাও শোনাত। তবে আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম, আমি ক্রিকেটার হবই। আমার একটাই স্বপ্ন ছিল!

শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন ধরা দিল আপনার হাতে...

হ্যাঁ, কিন্তু যেটা বলছিলাম, সহজে ধরা দেয়নি। আমি যখন লালমনিরহাটে ছিলাম, তখন তো আশপাশের মানুষ প্রচুর কথা বলত। বলত, আরে এটা তো মেয়ে না ছেলে! সারাদিন ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে। সারাদিন এই করে ওই করে। আমি যেহেতু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপে বুঁদ ছিলাম, আমার কাছে সেসব খারাপ না লাগলেও বাবা-মা এ নিয়ে অনেক ভুগেছেন। কারণ আমরা তো সমাজেই থাকি। তখন মেয়েকে নিয়ে কেউ কিছু বললে কষ্ট তো হবেই বাবা-মার। তারা আসলে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছে বলেই আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।

নারীদের নিয়ে এভাবে কথা বলাটা নতুন কিছু নয়...

একদম, ঠিক! তবে আবার দেখুন, যখনই আমি জাতীয় দলে খেললাম, সফলও হলাম, যখন সব পত্রিকা আর টিভিতে আমাকে নিয়ে নিউজ হলো, তখন সেই তারাই পুরো উল্টো। আমার প্রশংসা শুরু করল। তখন দেখি আমাদের পরিবারের সঙ্গে ব্যবহারটা পাল্টে গেল।

আপনি এখন ধারাভাষ্য নিয়ে আছেন। আপনি এখানেও পথ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে স্টার স্পোর্টসের মতো বড় প্ল্যাটফর্মে ধারাভাষ্য দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা আসলে কেমন ছিল?

এটা আসলে আমি কখনো চিন্তাই করিনি। বিশেষ করে স্টার স্পোর্টসের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কমেন্ট্রি করব। অবশ্য ২০১৩ সাল থেকেই দেশে ধারাভাষ্য দিতে শুরু করেছি। জিটিভি, মাছরাঙা অনেক জায়গায় দিয়েছি। আগে তো আমাদের খেলা একেবারে কম হতো, তখন খালি সময়টা বসেই থাকতাম। সময় কাটাতে কমেন্ট্রি করতে শুরু করি। সেটা আমার বেশ উপকারে এসেছে। কারণ তখন প্রতিটি বল মনোযোগ দিয়ে দেখতে পেরেছি। বিশ্লেষণ করে ভুলগুলোও শুধরাতেও পেরেছি। ধারাভাষ্য করে যখন মাঠে খেলতে যেতাম তখন আরও বেশি ম্যাচিউরড হয়ে উঠি। স্টার স্পোর্টসে হঠাৎ করেই হয়ে গেছে। সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) এই পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। স্টার স্পোর্টসে ছোট্ট একটা অডিশনও দিতে হয় আমাকে। সেখানে উতরে গিয়েই সুযোগটা পাই। প্রথমদিন গিয়েই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারতের খেলাটা পেয়েছি। কোনো কিছু বোঝার আগেই এমন বড় একটা জায়গা পেয়েছিলাম। 

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল এখন সাফল্য পাচ্ছে। এশিয়া কাপও জয় করেছেন সালমা খাতুনরা। যা ছেলেরাও পারেনি। নারী ও পুরুষের যে ক্রিকেট চলছে এর মধ্যে দেখা যায় অর্থের সাম্যতা নেই। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক কম পায়। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণটা শুনতে চাই...

দেখুন, সত্যি যদি বলি আমরা কিন্তু ছেলেদের জায়গায় যেতে পারিনি। ছেলেদের জন্য স্পন্সর রয়েছে। মেয়েদের জন্য স্পন্সর নেই। এই সাম্যতাটা তখনই আসবে যখন আপনার জন্যও স্পন্সর থাকবে। বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য এখনো সেভাবে কোনো স্পন্সর নেই। আমরা যদি এ অবস্থায় বিশ্বকাপে ভালো করি, একটা জায়গায় যেতে পারি, তাহলে সাম্যতা আসবে। ছেলেদেরও প্রথম দিকে এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। 

আমাদের ক্রিকেটের কিংবদন্তি আকরাম খান-আমিনুল ইসলামরাও আর্থিক দিক থেকে তেমন কিছুই পাননি, এখন সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালরা যেমনটা পান...

এটাই বলতে চেয়েছিলাম আমি। মনে করেন এখন আমরা মেয়েদের আকরাম-বুলবুল। এরপর যারা আসবে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে। এখনই অনেকটা বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে। এখন আমরা যদি হঠাৎ করেই এশিয়া কাপ জিতে গেছি বলে সমান সমান কিংবা ছেলেদের কাছাকাছি পারিশ্রমিক চাই, সেটা আসলে সম্ভব নয়। স্পন্সর না দিলে টাকা দেওয়ার উপায় নেই। আমার মনে হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু হবে। এখন আমরা যদি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হই কিংবা রানার্স আপ হই তাহলে কিন্তু এমনিতেই ছেলেদের কাছাকাছি চলে যাব। যেমনটা ভারতের মেয়েদের জন্য হয়েছে। 

এটা তো ক্রিকেট মাঠের কথা বললেন, আমরা যদি সমাজে চোখ ফেরাই, এখানেও নারী-পুরুষের সাম্য তৈরি হয়নি, নারীরা অনেক জায়গাতেই প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটা সমাজের জন্য দেশের জন্য নারী-পুরুষে এই সাম্যতা কতটা জরুরি?

দেখুন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় যে নারীদের সম্মানটা সবার আগে দেওয়া উচিত। আর সেটা প্রতিটি পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে। আমরা পরিবারে যদি সম্মান না পাই তবে বাইরে গিয়ে সম্মান সম্মান করে চিৎকার করলেও কিছু হবে না। যখন নারী মেয়ে থাকবে, যখন নারী স্ত্রী হবে কিংবা একসময় মা হবে শাশুড়ি হবে সবারই আসলে পরিবার থেকে সম্মানটা পাওয়া উচিত। সব জায়গায় নারীরা যখন কাজ করে তখন শুনি তাদের অনেক হেনস্তার শিকার হতে হয়, সঠিক সম্মানটা পায় না অনেকে, কটু কথা বলে, এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সবার। অত্যাচার বা নির্যাতন সেটা যে শুধু শারীরিক, তা কিন্তু নয়। মানসিক ব্যাপারটাও আছে। মেয়েরা অনেক ব্যাপারেই ছেলেদের চেয়ে নরম, তাদের সম্পর্কে একটু বাজে কথা বললে তারা ভেঙে পড়ে। মেয়েরা এসব ব্যাপারে মানসিকভাবে আপসেট হয়ে পড়ে। এসব বন্ধ করতে হবে। 

আপনার জায়গায় আপনি সফল একজন নারী। এ কারণেই প্রশ্নটা রাখতে চাই, একজন নারী অথবা একজন মানুষের সফল হতে গেলে কী যোগ্যতা বা গুণ প্রয়োজন..

আমার কাছে যেটা মনে হয় সবার আগে আত্মবিশ্বাসটা থাকতে হবে। আশেপাশে কোনো কথায় কান দিলে হবে না। আপনি ভালো কাজ করলেও কথা হবে। খারাপ কাজ করলে তো কথা হবেই! মানুষের কথায় ভয় পেলে চলবে না। নিজের কাজ নিজে সৎভাবে করতে পারলে তিনি অবশ্যই সফল হবেন। একজন সফল নারীর ডেফিনেশন যদি আমার কাছে জানতে চান তবে বলবো- সবকিছু ঠিক রেখে বাড়ি, পরিবার সমাজ ঠিক রেখে নিজের কাজের প্রতি সৎ হওয়া আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া। নিজের কাজ নিজে করা, বাবা, হাজবেন্ড কারও প্রতি নির্ভরশীলতা নয়, যে ওরা দশ টাকা দেবে সেটায় তাকিয়ে থাকব। নির্ভরশীলতা থাকতে হবে নিজের ওপর। স্বাধীনচেতা বলতে আমরা অনেকেই উগ্র ভাবি, সেটা না। স্বাধীনচেতা হয়েও নিজের পরিবারের সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার সম্মতিতে সব কাজ করা যায়। আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি, কিছু কাজ করার আগে কিন্তু আমি আমার হাজবেন্ডকে জিজ্ঞাসা করি। জানতে চাই, কাজটা ভালো হবে কি না। স্বাধীনচেতা মানে কারও পরামর্শ নিলাম না, নিজের মতো সব করলাম, তা কিন্তু না। সবার পরামর্শ নিয়ে সঠিক কাজ করতে পারলেই সফল আর আদর্শ একজন হয়ে ওঠা যাবে।

পরিবারের কথা বলছিলেন, আপনার পরিবারের মানুষদের কথা শুনতে চাই। সন্তান সামলে, সংসার সামলে খেলেছেন আপনি..

আমার একটা মেয়ে আছে। তার বয়স চার বছর। আমার হাজবেন্ড একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। আমি আমার  শ্বশুড়-শাশুড়ির সঙ্গেই থাকি। আমার মেয়ের বয়স যখন ১ মাস তখন থেকেই তাকে নিয়ে কাজ করছি আমি। সে এখনই অনেক সাপোর্টিভ। আামাকে অনেক বোঝে। আমার শ্বশুড়-শাশুড়ি আর হাজবেন্ড সবাই আমার কাজে অনেক সাপোর্ট করে। খেলাধুলা, ধারাভাষ্য সবকিছুতেই তাদের সমর্থন থাকে। যখন আমি খেলা কিংবা কমেন্ট্রির কারণে ঢাকার বাইরে যাই, তখন আমার সন্তান তাদের কাছেই থাকে। সবাই সাপোর্ট করে বলেই এভাবে পথ চলতে পারছি আমি।

এক নজরে
নাম: সাথিরা জাকির জেসি
জন্ম তারিখ: ৩০ নভেম্বর, ১৯৯০
জন্মস্থান: পাটগ্রাম, লালমনিরহাট
মা: হাসিনা আক্তার
বাবা: মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
ভাই-বোন:  এক ভাই এক বোন 
স্বামী: শেখ মোহাম্মদ নাসের
পেশা: ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার
শখ: সিনেমা দেখা, গান শোনা
আন্তর্জাতিক ওয়ানডে: ২টি 
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি: ১টি