ছবি: সংগৃহীত

হবিগঞ্জের মাঠে তার পরিচয় ছিল ‘অপুর ভাই অনিক’। কারণ অপু নিজের ক্রিকেট প্রতিভা দিয়ে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন একজন উইকেটকিপার ব্যাটার হিসেবে। বড় ভাইয়ের মতই উইকেটকিপার ব্যাটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল অনিকের। তাই অপুর কাছেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি তার। ছোট হাতে বড়দের সাইজের কিপিং-গ্লাভস, দূর থেকে দেখেই পরিষ্কার বুঝা যায় তিনি মানিয়ে নিতে পারছেন না, তারপরও প্রাণ-পণে বল ধরার চেষ্টা। সেই চেষ্টা আর অধ্যবসায়ের বেলায় চড়েই অনিক এখন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। 

হবিগঞ্জ জেলা অনূর্দ্ধ-১৩ দলে খেলার মধ্য দিয়ে ক্রিকেটের পথে স্বপ্ন বুনা শুরু অনিকের। অল্প সময়েই বিকেএসপিতে নিজের ক্রিকেট প্রতিভায় জায়গা করে নেন তিনি। এরপর প্রথম বিভাগ, প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট আর বয়সভিত্তিক সব দল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান অনিক।

গত বুধবার (২২ মার্চ) আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন তিনি। আইরিশদের বিপক্ষে এই সিরিজে তিনি বিবেচনায় এসেছেন মূলত ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স দিয়ে, এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি বলেন, ‘জাকেরকে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স বিবেচনা করে নিয়েছি।'

দলে সুযোগ পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে ঢাকা পোস্টকে অনিক বলেন, 'আমার পরিবারের সমর্থনের জন্যই আজ আমি এতটুকু আসতে পেরেছি। আমার বড়ভাই সাকের আলী অপুর হাত ধরেই আমার ক্রিকেটে যাত্রা। এছাড়াও আমার বোন সাবেক প্রমীলা ক্রিকেটার শাকিলা ববি আমাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়েছেন। মূলত আমার পরিবারের জন্যই আমার এতটুকু আসা। নইলে সবকিছুই অসম্ভব ছিল।'

'বিগত কয়েক মৌসুম ধরে আমি বিভিন্ন লিগে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করেছি। তার জন্যই হয়তবা নির্বাচকরা আমাকে বিবেচনা করেছেন। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া সব খেলোয়াড়ের জন্যই খুবই আনন্দের। আমি যেন জাতীয় দলের জন্য ভাল কিছু করতে পারি সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।'

২০১৬-১৭ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট লিগে সিলেট বিভাগের হয়ে তিনি প্রথম সারির ক্রিকেটে প্রথমবার খেলার সুযোগ পান। একই বছর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলেন অনিক। পরের বছরই ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে 'লিস্ট এ' ক্রিকেটে তার অভিষেক হয়।এরপর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে সিলেট সিক্সার্সের হয়ে খেলেন অনিক।

অনিকের এমন ধারবাহিক ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল তার বড় ভাইয়ের হাত ধরেই। অনিক জাতীয় দএল সুযোগ পাওয়ার পর তার বড় ভাই সাকের আলী অপু বলেন, 'বিকেএসপিতে যাবার আগ পর্যন্ত আমিই তাকে ক্রিকেটের সবকিছু শেখাতাম। কিপিং ও ব্যাটিং সম্পর্কে অনিককে আমিই ধারণা দিয়েছি। পরবর্তীতে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার দ্বারা আর হবে না। ওর খেলার ধরণ দেখে বুঝা যাচ্ছিল ও অনেক প্রতিভাবান। তাই তাকে ভাল একটা জায়গায় সেট করতে হবে। তখন বিকেএসপিতে ট্রায়ালের জন্য অনিককে আমিই নিয়ে যাই। বড়ভাই হিসেবে আমার খুব ভাল লাগছে। এটা আমাদের পরিবারের অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। অনিককে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের পরিবারের সবাই সাপোর্ট করেছে। আজ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায় আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।'

'২০১০ সালে ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় জাকের আলী অনিকের। আমি হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ও প্রথম বিভাগ ক্রিকেট যখন খেলি। অনিক তখন আমার সাথে মাঠে যেত। তখন তার বয়স প্রায় ১২। অনিক আমাকে বলত, 'আমি তর মত উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হতে চাই।' তখন আমি বলতাম, 'তুই তো অনেক ছোট। ক্রিকেট বল অনেক হার্ড। তুই ব্যথা পাবি।' কিন্তু তারপরও সে বলে আমি পারব। তারপর আমি তাকে গ্লাভস পরিয়ে দেই। দেখলাম অনিক অনেক ভাল করছে। তারপর হবিগঞ্জে একটি ট্রায়ালে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সেই ট্রায়ালে সুযোগ পায়। এতে সে হবিগঞ্জ জেলা অনুর্দ্ধ ১৩ ক্রিকেট দলে সুযোগ পায়। এরপর ২০১৩ সালে বিকেএসপির একটি ভর্তি সার্কুলার হলে অনিককে সেখানে পাঠাই। কয়েকশ’ আগ্রহীর মধ্যে ২৪ জনের দলে সুযোগ হয় অনিকের।'

জাকের আলী অনিকের বড় বোন নূরজাহান বিভা বলেন, 'আমরা ৫ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট জাকের আলী অনিক। আজকের এইদিনটি দেখার জন্য আমরা অনেকদিন ধরেই অপেক্ষায় ছিলাম। আজ এই খুশির দিনে আব্বাকে খুব মনে পড়ছে। আব্বা আজ থাকলে এই খুশিটা আমাদের দ্বিগুণ হত। এই সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার ভাই সাকের আলী অপু ও আমার বোন শাকিলা ববির।'

তার বোন সাবেক প্রমীলা ক্রিকেটার শাকিলা ববি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, 'সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। দীর্ঘ একযুগের সাধনার ফল পেয়েছে অনিক। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমে জায়গা করে নিতে হলে ভাল খেলার কোনো বিকল্প নেই। তাই ওর দৃঢ় লক্ষ্য ছিল বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার।'

হবিগঞ্জের ছেলে জাকির আলী অনিক জাতীয় ক্রিকেট দলে ডাক পাওয়ায় হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গণে আনন্দের বন্যা বইছে। অনিক জাতীয় দলে ডাক পাবার খবরটি যখন পাওয়া যায়, তখন হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট চলছিল। খবর পাবার সাথে সাথে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। আর সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুক ভরে ওঠেছে জাকির আলী অনিককে অভিনন্দন বার্তায়।

হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ইব্রাহিম খলিল সোহেল বলেন, 'সেই ছোটবেলা থেকেই অনিককে দেখছি। তখন থেকেই তার মধ্যে ক্রিকেটের প্রতিভা দেখে আমরা তাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। আমরা জানতাম অনিক অনেক বড় খেলোয়াড় হবে। আজকে সে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পাওয়ায় হবিগঞ্জের ক্রিকেট তথা সমগ্র ক্রীড়াঙ্গণে আনন্দ বিরাজ করছে।'

১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ শহরের ঝিলপাড় এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন অনিক। ৩ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট এই ক্রিকেটার। বাবা প্রয়াত মো. শওকত আলী ও মা মানিক চাঁন। বাবা-মা কেউই খেলার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অনিকের স্ত্রী নাফিসা তাবাসসুম বিকেএসপির শুটার। 

আজহারুল মুরাদ/এইচজেএস