সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল/ফাইল ছবি

‘ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল/ জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল...’ কালের সে যাত্রাধ্বনি কি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শুনছে? সবকিছুরই একটা শেষ আছে, প্রকৃতির সে অমোঘ নিয়ম মেনে শেষের কাছে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন দেশের ক্রিকেটের দুই মহীরুহ সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। তার প্রস্তুতি কতটা নিয়েছে বাংলাদেশ?

আগস্ট, ২০০৬। বয়সভিত্তিক দলের দারুণ পারফর্ম্যান্স দিয়ে দলে এলেন এক তরুণ, সাকিব আল হাসান। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকে চোখধাঁধানো কিছু অবশ্য করতে হয়নি তাকে। ব্যাট হাতে ত্রিশ রানের একটা ইনিংস আর বল হাতে একটা উইকেট, দলের জয়ে অবদানটা খুব বড় কিছু ছিল না সেদিন।

ফেব্রুয়ারি, ২০০৭। বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহুর্তে দলে এলেন আরেক তরুণ তুর্কি, তামিম ইকবাল। ভেন্যু সেই হারারে, প্রতিপক্ষ সেই জিম্বাবুয়ে। তার অভিষেকটা হলো আরও বিবর্ণ। মাত্র পাঁচ রানের ইনিংস খেলে ফিরেছিলেন সেদিন। 

শুরুটা খুব বেশি স্মরণীয় না হলেও দু’জনে এরপর বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজেদের আলাদা জায়গাই করে নিয়েছেন। অভিষেকের কিছু পরেই বিশ্বকাপে দারুণ স্পর্ধা দেখিয়ে তামিম ইকবাল মেরেছিলেন লং অন দিয়ে জহির খানকে ছক্কা, যা দেশের ক্রিকেট রূপকথারই দারুণ একটা হাইলাইট। তবে সে ম্যাচে দু’জনে পেয়েছিলেন অর্ধশতকের দেখা, যা বাংলাদেশকে দেখিয়েছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, পরের এক-দেড় দশকের প্রতিচ্ছবি। সেটা পরে ভালোভাবেই ফুটে ওঠেছে দেশের ক্রিকেটে, দু’জনে হয়েছেন দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, অনেক ইতিহাসের কুশীলবও বনেছেন তারা।

তবে চিরস্থায়ী কোনো কিছুই নয়। সে অমোঘ সত্যেরই কাছে একটু একটু করে ছুটে যাচ্ছেন দু’জনে, ধীরে ধীরে। সাম্প্রতিককালে ঘুরে ফিরেই আসছে সে কথা। 

তামিম যেমন এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘আমি যদি আরও চার-পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলে যেতে চাই, তাহলে মনে হয় না তিনটা ফরম্যাটে একসঙ্গে খেলতে পারব। বেছে নিতে হবে কোন দুটোয় দলকে সাহায্য করতে পারবো, আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা যেমন এখন হতে পারে, হতে পারে ছয় মাস পরেও। হতেও পারে, দুই ফরম্যাট নয়, খেললাম এক ফরম্যাটে। ২০২১ সালেই দেখতে পারেন (অবসরের ঘোষণা), খুব সম্ভব!’ 

সাকিব আরেক সাক্ষাৎকারে যা বললেন, তাতে তো পিলে চমকে যাওয়ার কথা। জানালেন, ‘হুট করে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি’! তবে তিন ফরম্যাটের একটা একটা করে ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনিও। 

যেহেতু এখন তিনটি ফরম্যাট, একটা একটা করে হয়তো ছাড়ব, একসঙ্গে নয়। দেখতে হবে যে কোনটায় ভালো করছি , কোনটা অতটা ভালো করছি না। যেটা ভালো করব না, মনে হবে যে আমি না থাকলেই দলের ভালো, সেটাই আগে ছাড়ব।

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

বিষয়টা অবশ্য অবধারিতই ছিল। কোনো একটা সময় বিদায় নিতেই হবে তাদেরকে। তার একটা নমুনারই দেখা মিলেছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত টি-টোয়েন্টি সিরিজে। সাকিব আগে থেকেই ছিলেন না সফরে, তামিমও চলে এসেছেন সিরিজের মাঝপথে। তবে তাদের ছাড়া দল পাসনম্বর পেয়েও উতরে যেতে পারেনি। তাতে প্রশ্নও চলে আসে বেশ, সাকিব-তামিমের অবসরের পর কি এই হবে বাংলাদেশের নিয়তি? সে সময়ের জন্য কতটা প্রস্তুত দল?

অন্তত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম মানছেন সাকিব-তামিমদের অবসর পরবর্তী সময়ের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিটা অপ্রতুল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বললেন, ‘আমাদের একটা ধারণা ছিল যে সাকিব-তামিম পরবর্তী যুগের জন্য আমরা প্রস্তুত। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সফর, তার আগে-পরে মনে হচ্ছে না বিষয়টা তেমন। এখন মনে হচ্ছে, যতটা প্রস্তুত মনে হচ্ছিল নিজেদের, আমরা আসলে ততটা প্রস্তুত নই।’ 

এর দায় পুরোপুরি ক্রিকেটারদেরই নয়, দায় আছে ক্রিকেট কাঠামোরও, মনে করেন নাজমুল আবেদিন। 

এর দায় ক্রিকেটারদের নয়, কাঠামোরও। সিস্টেম্যাটিকালি আমরা ভুল করে আসছি, যার কারণে আমাদের ক্রিকেটাররা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসতে পারছে না। ঠিক প্রস্তুতি না নিলে আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময় লাগবে অনেক।’

নাজমুল আবেদিন ফাহিম, ক্রিকেট উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

গুরু নাজমুল আবেদিনের সঙ্গে সাকিব/ফাইল ছবি

শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারদের বিদায় যেমন পারফর্ম্যান্সের দিক থেকে প্রভাব ফেলে দলে, তেমনি ফেলে নেতৃত্বের সঙ্কটেও। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই দুই মহীরুহ ও অন্য সিনিয়রদের বিদায়ও তেমন সমস্যাই তৈরি করতে পারে দলে, মনে করেন নাজমুল আবেদিন। 

তার কথা, ‘খেলোয়াড়দের একটা লিডারশিপ রোল পালন করতে হয়। সেখানে একটা শূন্যতা তৈরি হবে নিঃসন্দেহে। আমরা দলীয় নেতৃত্ব হারাচ্ছি, এ কারণে ব্যক্তিগতভাবেও এর ছাপ পড়ছে। আমার তো নিউজিল্যান্ডের খেলা দেখে মনে হয়েছে যে প্রত্যেকটা খেলোয়াড় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। দলের সবাই একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, একে অন্যকে সাহস দিচ্ছে এটা মনে হয়নি। দলের সবাই সবসময় ভালো খেলে না, কিন্তু ভালো না খেললেও একজন অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারে সাহস দিতে পারে। আমি খেলোয়াড়দের দোষ দিচ্ছি না। আমাদের সিস্টেমই এমন না, এখানে সে বিষয়টা আসে না। এ ঘাটতিটাও বড় হয়ে দেখা দেবে সামনে, মনে হচ্ছে।’ 

এ শূন্যতা কী করে সামলাবে বাংলাদেশ? সে সমাধানও বাতলে দিচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সাবেক এই কোচ। জানালেন মিথ্যে আত্মতুষ্টি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তাকাতে হবে সামনের দিকে। 

সংশ্লিষ্টদেরকে এ অবস্থানটাকে মেনে নিতে হবে। মেনে নিতে হবে আমাদের অবস্থানটা কোথায়। আমরা যদি মিথ্যে একটা আত্মবিশ্বাস প্রচার করি, ‘এসব কোনো ব্যাপারই না, ঠিক হয়ে যাবে সব’ বলি, নিজেরা বিশ্বাস করি, তাহলে ব্যাপারটা ভুল হবে। পিছিয়ে পড়েছি, ব্যাপারটা স্বীকার করতে হবে। আর সেখান থেকে আমরা কীভাবে ফিরে আসবো সেটা হিসেব করতে হবে। প্রথম কাজটা হবে স্বীকার করা কোথায় আছি।’ 

নাজমুল আবেদিন ফাহিম, সাবেক ব্যবস্থাপক, গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ, বিসিবি

ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগ, যথার্থ মূল্যায়ন হতে হবে উপলব্ধি ও স্বীকারোক্তির ঠিক পরের ধাপ। নাজমুল আবেদিনের ভাষ্য, ‘আমরা যদি ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগী হই, অকারণে যে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অভ্যাসটা পরিহার করি, আর যথাযথভাবে মূল্যায়ন করি, একটু একটু করে এগোই; তাহলে মনে হয় আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারবো। কারণ যেসব খেলোয়াড়রা এখন খেলছে অভিজ্ঞদের বাইরে, তারাও অত্যন্ত মেধাবী খেলোয়াড়।’

কাঠামোয় পরিবর্তন, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশও আনতে হবে ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোয়। তবেই কেবল এ শূন্যতা দ্রুততম সময়ে পূরণ সম্ভব, মনে করেন নাজমুল আবেদিন। তিনি বলেন, ‘সিস্টেমে পরিবর্তন আনলে, প্রতিযোগিতামূলক একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারি, তাদেরকে নেতৃত্বের ব্যাপারটায় তাদের ইনভলভ করতে পারি, তাহলে আমি মনে করি ফিরে আসা সম্ভব। যেহেতু আমরা চার পাঁচ বছর আগেও আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি, সে বিষয়টা আমি মনে করি আমাদের কাছে অজানা কিছু নয়। একটা সিস্টেম ডেভেলপ করতে পারি, তাহলে আমি মনে করি ফিরে আসা সম্ভব খুব তাড়াতাড়ি।’

এনইউ/এটি