বাবরকে পেছনে ফেলা সেই বিজয়ের সঙ্গী এখন আক্ষেপ
প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানায় সেয়ানে সেয়ানে। তুলনা হয় সমপর্যায়ের কারো সঙ্গে। নিশ্চয়ই ভাবছেন হঠাৎ কেন তুলনার পাল্লায় বাবর আজম ও এনামুল হক বিজয়? দীর্ঘদিন আলোচনার বাইরে থাকা বিজয় আর বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো বাবর আজমের তুলনা সামনে আসছে কেন?
অনেকেই বলতে পারেন- কোথায় বাবর, কোথায় বিজয়! অথচ ২০১২ সালের গল্প ভিন্ন কথা বলে। ‘১২’ সংখ্যাটিতে উল্টে দেখুন ‘২১’ হয়, এভাবেই যেন উল্টো গেছে এ দুজনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
বিজ্ঞাপন
অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নাম লেখান বিজয়। তবে আশার বেলুনে হাওয়া দেওয়ার কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেননি তিনি। হারিয়ে গেছেন দৃশ্যপট থেকে, আড়ালে, অন্ধকারে! শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই থেকে তো আগেই ছিটকে গেছেন বিজয়, হারাতে বসেছেন নিখাদ সমর্থকদের মন থেকেও। আবার যে বাংলাদেশ দলের জার্সি গায়ে চাপাবেন, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বলা যায় পাথরে ফুল ফোটানোর বৃথা চেষ্টার মতো।
হাল ছাড়েননি বিজয়, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করছেন। তবে মন গলাতে পারছেন না নির্বাচকদের। এনিয়ে কাউকে দোষারোপ করতে নারাজ এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। বরং ভাগ্যকেই দোষেন তিনি। সবকিছুই ছেড়েছেন নিয়তির হাতে।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে পাকিস্তানি অধিনায়ক বাবর আজম শুধু পাকিস্তান দলকেই কেন, বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্ব ক্রিকেট নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২৬ বছর বয়সী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
বয়সের দিক থেকে বাবরের চেয়ে দুই বছরের বড় বিজয়। তবে দুজনেই ডানহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। এর বাইরে মিল খুঁজতে গেলে ২০১২ সালে ফিরে যেতে হবে। আলোচনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন দুজন। সেই টুর্নামেন্টে সবাইকে ছাড়িয়ে বাজিমাত বিজয়ের।
ব্যাট হাতে রান বন্যা বইয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। ৬ ইনিংসে দুই সেঞ্চুরির সাহায্যে প্রায় ৮১ গড়ে ৩৬৫ রান করেন বিজয়। রান সংগ্রাহকের তালিকার দ্বিতীয় নামটি বাবরের। সমান ম্যাচ খেলে বিজয়ের থেকে ৮৮ রান কম করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টিন ডি কক ছিলেন চতুর্থ নাম্বারে। তিনি করেন ২৮৪ রান।
সেই বিজয় আজ নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। অথচ ডি কক, বাবররা প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেদেরকে। একটি একটি সিঁড়ি এগিয়ে বাবর তো এখন একদম চূড়ায় উঠে বসেছেন। ব্যাট হাতে দখল করেছেন আইসিসির ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর জায়গাটা। বিরাট কোহলিকে সিংহাসনচ্যুত করে এই নজির গড়েছেন বাবার। এর পর থেকেই আলোচনায় বাবর-বিজয় ইস্যু।
সম্ভাবনার বার্তা দিয়েও কেন হারিয়ে গেলেন বিজয়? অথচ বাবর হাঁটলেন সঠিক পথেই। দুজনের পরিসংখ্যান তুলনায় যেকেউ দুষবেন বিজয়কে। অথচ বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। বিজয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছেন ২০১২ সালে। বাবরের পথচলা ২০১৫ থেকে। তখন বিজয়ের ক্যারিয়ার মধ্য গগন থেকে পশ্চিমে ঢেলে পড়তে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় না বলা বিজয় এই ৯ বছরে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে খেলেছেন মাত্র ৫৫ ম্যাচ। যেখানে ওয়ানডে খেলেছেন ৩৮টি। সাড়ে ৫ বছরের ক্যারিয়ারে পাকিস্তানের জার্সিতে বাবর খেলে ফেলেছেন ১৬২ ম্যাচ, এর মধ্যে ওয়ানডেই ৮০টি।
২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক বিজয়ের। প্রথম ৩ ম্যাচে তার রান যথাক্রমে; ৪১, ১২০ ও ৩৩। সে বছর মোটে ৫টি ম্যাচ খেলেছেন বিজয়। ২০১৩ সালে ৪টি। সব থেকে বেশি ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৪ সালে। সে বছর ক্যারিয়ার সেরা ফর্মে ছিলেন বিজয়। ১৭ ইনিংসে ৬৩১ রান, ২ শতক এবং ৩টি অর্ধশতক। পরের বছর বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে কাঁধের চোটে ছিটকে যান। ফিরলেন ২০১৮ সালে। খেললেন মোটে ৭ ম্যাচ। সবশেষে মাঠে নেমেছেন ২০১৯ সালে। এবার ভাগ্য জুটেছে এক ম্যাচ। অথচ বাবর সফল হোক বা ব্যর্থ, নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন পাকিস্তানের জার্সি গায়ে।
আক্ষেপ নিয়ে বিজয় জানান, ‘বাবর আজম তো আমার সময়ের খেলোয়াড়। এখন ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিড করছে। ডি কক আমার সমসাময়িক। জো রুটও একই সময়ের। তারা লিড করছে। আমারও তো কষ্ট লাগে, আমি ওদের মতো হতে পারছি না কেন? আমি তো ওরকম লেভেলেই যাচ্ছিলাম, কেন আজ আমি নিচে আসলাম? আমার ২১ ম্যাচে তিনটা একশ হয়ে গিয়েছিল, তাহলে আমি তো ওদের কাছাকাছি যেতে পারতাম। আমি যদি কন্টিনিউ করতাম তাহলে ১৫টি সেঞ্চুরি থাকতেই পারতো। আমি তো আশা করতেই পারি।’
বিজয় আরও যোগ করেন, ‘২০১৫ সাল থেকে শুরু করে আমি যদি কন্টিনিউ খেলতাম, যদি প্রতি বছর ১৫ টা করেও ওয়ানডে খেলতাম তাহলেও এখন আমার ওয়ানডে খেলা হতো ১০০টি। ২১ ম্যাচে যদি তিনটা (সেঞ্চুরি) হয়, তাহলে আপনি ১০০ ম্যাচে ১০টি, ১৫টি ধরতেই পারেন। আমি আমার কষ্টের কথাটা শেয়ার করলাম বা আমি এনভায়রনমেন্টের কথাটা বলছি। আল্টিমেটলি যদি আমাকে ওয়ার্ল্ডে শো করতে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
ক্যারিয়ার প্রথম ২০ ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকান ডি ককের সেঞ্চুরি ছিল পাঁচটি। পাকিস্তানের বাবর আজমের তিনটি, ইংল্যান্ডের জো রুট কোনো শতকের দেখা পাননি। অন্যদিকে বিজয় সমান ম্যাচ খেলে তিনটি সেঞ্চুরি পেয়ে যান। ২০১৩ সালে অভিষেক হওয়া ডি কক ১২৩ ম্যাচে বর্তমানে ১৫ ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক। ২০১৫ সালে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া বাবর আজমের নামের পাশে ৮০ ম্যাচে ১৩ সেঞ্চুরি। অথচ ২০১২ সালে অভিষেক হওয়া বিজয় ৩৮ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরিতে আঁটকে আছেন।
বিজয়ের আক্ষেপ আছে আরো। তার আক্ষেপ এখানকার পরিকাঠামো আর প্রস্তুতি নিয়ে, ‘আমি যখন ইংল্যান্ডে গেছি, আমি দেখেছি একটা প্লেয়ার একটা সেন্টার উইকেটে একটা কোচ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাউন্সি ট্রাকে অনুশীলন করতে। আমরা যে ৭ দিন ২ ঘন্টা করে করলাম মনে করেন টানা একা একা ৭ দিনে ১৪ ঘন্টা। আর সে একদিনে ৫-৬ ঘন্টা ব্যাটিং করেতেছে। তার ট্রেনিং একমাসে যা হয় আমাদের তা এক বছরে হয় না। সো অনেক পার্থক্য আছে। অনুশীলনের পার্থক্য আছে, ফেসিলিটির পার্থক্যও আছে। অনেককিছু এর ভেতরে ইনভলভ।’
বিজয় জানাচ্ছিলেন, ‘এখন আমি যদি জাতীয় দলে যাই, তাহলে আমি কি চিন্তা করবো? যে আমি কোনরকমে ৪০ রান করি, যাতে আমি টিমে থাকি। কিন্তু আমি যদি মন খুলে খেলতে পারি। আমি দুই বা তিন ম্যাচ খারাপ খেলছি, আমি নামবো প্রতিদিন দেশের জন্য। প্রতিদিন মন খুলে খেলবো। ভালো খেলি-খারাপ খেলি সেটা পরের বিষয়। টিম আমাকে সাপোর্ট করবে। মুশফিক ভাই জানেন যে, সে ড্রপ হবে না, সে কন্টিনিউয়াসলি খেলবে, ওনার খেলার স্ট্রোকই অন্যরকম আসবে। যেকোন ওভারে হুট করে ফ্লিক খেলে দিবে, কোন ব্যাপার হবে না।’
এমন আক্ষেপই ঝরল এনামুলের কন্ঠে। এক সঙ্গে দৌড় শুরু করে একজন যখন ফিনিশিং টাচে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, অন্যজন যখন দৌড় শুরুর পর পথ হারালেন, তখন তো এক রাজ্যের হতাশাই সঙ্গী হয়!
টিআইএস/এটি/এনইউ