২০২৩ সালের গৌধূলীতে এসে পৌঁছেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। ষোলোআনা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই বর্ষবিদায়ে প্রস্তুত ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। নারী ও পুরুষ ক্রিকেট মিলিয়ে এই বছর তারা তিনটি বিশ্ব ‘মুকুট’ পরেছে। মেয়েরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর ছেলেরা হাতে তুলে নিয়েছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা।

বিপরীতে আক্ষেপের একটি বছর কাটিয়েছে রোহিত-কোহলিদের ভারত। প্যাট কামিন্সদের জেতা দুটি ফাইনালেই প্রতিপক্ষ ভারত ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছে। ফিরতে হয়েছে বিশ্বমঞ্চে সাফল্যের অপেক্ষা দীর্ঘ করে। একই সময়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে মঞ্চস্থ হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্ক্রিপ্টের ‘নাটক’। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মিশেলে এই বছরে হয়েছে ত্রয়োদশ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। যেখানে দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা হারিয়েছিল।

এদিকে, ব্যস্ত সূচি নিয়ে আরেকটি নতুন বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে ক্রিকেটবিশ্ব। ২০২৪ ক্রীড়াবর্ষকে স্বাগত জানানোর লগ্নে বিগত ১২ মাসে ঘটে যাওয়া ক্রিকেটবিশ্বের আলোচিত ঘটনার ‍চুম্বকাংশ দেখে নেওয়া যাক—

৩টি বিশ্ব ‘মুকুট’ অষ্ট্রেলিয়ার

ক্রিকেট বিশ্বে চলতি বছরের শুরু ও শেষটাতে দারুণ মিল পাওয়া যায়। যেখানে হাড়ে হাড়ে সত্যি হতে দেখা যায় অজি ছেলেদের অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের দৃঢ় এক মন্তব্য। তার লক্ষ্য ছিল- আহমেদাবাদের লাখো দর্শককে বিশ্বকাপ ফাইনাল স্তব্ধ করে দেবেন। সেটা তারা তো করে দেখিয়েছেনই, তার আগে নারী দলও একই দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিল কোনো ঘোষণা ছাড়াই।

২০২৩ সালের শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেয় মেগ ল্যানিংয়ের দল। ক্যাপটাউনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৯ রানে হারিয়ে তারা টি-টোয়েন্টিতে টানা তৃতীয় শিরোপা জয়ের উৎসবে মাতে। এ নিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ৮ আসরের মধ্যে ৬ বারই চ্যাম্পিয়ন হলো আস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা। সর্বশেষ প্রোটিয়াদের হারানোর ম্যাচে বেথ মুনি ৫৩ বলে ৭৪ রানের ফাইনালসেরা এক ইনিংস খেলেন।

এ বছর প্রায় ৬ মাসের ব্যবধানে দুটি বিশ্ব শিরোপা জিতেছেন কামিন্স-ম্যাক্সওয়েলরা। ইংল্যান্ডের ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে শুরুতেই অজিদের চাপে ফেলে দিয়েছিল ভারত। ৭৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেই শুরু হয় ট্র্যাভিস হেডের প্রতিরোধ। স্টিভেন স্মিথকে নিয়ে গড়েন ২৯৫ রানের অনবদ্য জুটি। সাজঘরে যখন ফিরছেন তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১৬৩ রান। শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস যায় ৪৬৯ রান পর্যন্ত। যেখান থেকেই ম্যাচ জয়ের জন্য ভারতকে ৪৪৪ রানের লক্ষ্য দেয় অজিবাহিনী। মূলত প্রথম ইনিংসেই ম্যাচ খুইয়ে ফেলেছিলেন রোহিত শর্মারা। প্রথম ইনিংসে ২৯৬ রানের পর লক্ষ্য তাড়ায় ভারত থামে মাত্র ২৩৪ রানে। ফলে টানা দ্বিতীয় ফাইনালে উঠেও ভারত ২০৯ রানের বড় ব্যবধানে হারে।

এরপর ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চ পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল স্বাগতিক ভারতের জন্য। টানা ১০ ম্যাচ জিতে ফাইনালে ওঠা রোহিতদেরই অধিকাংশ ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এবারও ভাগ্য সহায় হয়নি, কারণ দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটাররা চূড়ান্ত মঞ্চে ওঠে খেই হারিয়ে ফেলে। আহমেদাবাদে ভারত ভুগেছে প্রথম ইনিংসের পরপরই। রান হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে কম। পঞ্চাশ পেরোনো লোকেশ রাহুল আর বিরাট কোহলিই কেবল বলার মতো কিছু করেছেন। পরে তাদের দেওয়া ২৪১ রানের টার্গেট অস্ট্রেলিয়া ছুঁয়ে ফেলে ৪২ বল আর ৬ উইকেট হাতে রেখেই। মার্নাস লাবুশেনের ফিফটির সঙ্গে ফাইনালজয়ী ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেছেন হেড।

এক বছরেই ২ ফাইনালে হার ভারতের

২০১৩ সালে ভারত সর্বশেষ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল। বিশ্বকাপের হিসেবে যে অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ। ২০১১ সালে ঘরের মাঠে ভারতীয়দের সর্বশেষ ওয়ানডে’র শ্রেষ্ঠত্ব তকমা এনে দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এরপর দুটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আর সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে কী দাপুটে অবস্থানই না ছিল ভারতের! ফাইনালের আগে ১০ ম্যাচের একটিতেও হারেনি রোহিতের দল। তাদের শুরুটাই হয়েছিল ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে নাকানিচুবানি খাইয়ে।

ফলে আসরজুড়ে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা ভারতের সামনে ছিল এক যুগ পর শিরোপার হাতছানি। ক্রিকেট পাগল দেশটিতে ম্যাচটি নিয়ে তাই উন্মাদনার কোনো কমতি ছিল না। ফাইনালকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশের ফরিদাবাদের একটি স্কুলে সেদিন (১৯ নভেম্বর) পরীক্ষাও পিছিয়ে দেওয়া হয়। দেশজুড়ে বাড়ি-মন্দিরে চলে বিশেষ প্রার্থনা। পেসার মোহাম্মদ শামির গ্রামের বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিশেষ দোয়া মোনাজাতের। 

ফাইনালের মহারণের ভেন্যু আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামেও রোববার নীল সমুদ্রে রূপ নিয়েছিল। জিতেগা ভারত স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছিল দৈত্যাকার মাঠ। শুধু কি মাঠ? সারা ভারতেরই এদিন যেন কাঁপছিল ক্রিকেট জ্বরে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণক্ষমতা এক লাখ ত্রিশ হাজারের মতো। তবে আরও এমন দু’চারটা স্টেডিয়ামের সমান আসন থাকলেও হয়তো কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো গ্যালারি। কিন্তু সাদামাটা ব্যাটিং প্রদর্শনীর পর অস্ট্রেলিয়া যখন ব্যাট করছিল, তখনই কী ফল আসছে— তা জানা হয়ে যায়। ফলে গ্যালারি পরিণত হয়েছিল সুনশান শ্মশানে।

৬ মাসের ব্যবধানে একই প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার কাছে দ্বিতীয় ফাইনালের সেই তিক্ত স্মৃতি এখনও রোহিত-কোহলিদের মনে বেদনা জাগায়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের টানা দুই চক্রের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। কিন্তু প্রথমবার নিউজিল্যান্ড এবং চলতি বছর তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয় কামিন্সদের হাতে।

ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে রেকর্ডময় এক বিশ্বকাপ দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। ভারত বিশ্বকাপে ছয় হয়েছে ৬৪৪টি, যা ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পেছনে পড়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপের ৪৬৩ ছক্কার রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি শতকের রেকর্ডও হয়েছে এই বিশ্বকাপে—৪০টি। এদিক থেকেও পেছনে পড়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া সেই আসরে ৩৮টি সেঞ্চুরি হয়েছিল।

এবারের আসরে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে ‘টাইমড আউটে’র শিকার হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। এছাড়া মাঠে বসে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখার রেকর্ডও হয়েছে এবার। আইসিসির ভাষ্যমতে– ভারত বিশ্বকাপে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেছে ১২ লাখ ৫০ হাজার ৩০৭ জন দর্শক। যেকোনো আইসিসি ইভেন্টে যেটা সর্বোচ্চ। ছাড়িয়ে গেছে ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে হওয়া সেই বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখেছিল ১০ লাখ ১৬ হাজার ৪২০ জন দর্শক।

অথচ ত্রয়োদশ বিশ্বকাপের শুরুর দিকে মাঠে দর্শকখরা নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড ম্যাচে আহমেদাবাদের গ্যালারি ভর্তি না থাকায় অনেক সমালোচনা হয়েছিল। যদিও ভারতীয়দের দাবি– সেদিনও মাঠে ছিল ৪০ হাজারের মতো দর্শক। এছাড়া ভারত-পাকিস্তানের প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে আহমেদাবাদে উপস্থিত ছিল প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক। আর ফাইনালে ৯০ হাজারের কিছু বেশি দর্শক ছিল ভারত–অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে।

তবে এতসব রেকর্ডের ভিড়েও অপ্রাপ্তি বলতে ছিল আয়োজকদের অব্যবস্থাপনা। বিশেষত ম্যাচের টিকিট পাওয়া পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই কালোবাজারির দৈরাত্মের কথা শোনা গিয়েছিল। ফলে টিকিট ‘সোল্ড আউট’ দেখালেও, আদতে গ্যালারির অনেকাংশ ফাঁকা থেকে যায়। এছাড়া বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না আয়োজকদের। ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচের মধ্যবিরতি এবং ফাইনালে প্রায় একই ঘরানার সাদামাটা অনুষ্ঠান নিয়েও দর্শকদের মাঝে ছিল বিস্তর হতাশা ও ক্ষোভ।

পিচ বিতর্কও ছিল বিশ্বকাপের অন্যতম আলোচিত বিষয়। শুরুর দিকে কয়েকটি ম্যাচ হয়েছিল ধর্মশালায়। অপরূপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর ওই ভেন্যুর আউটফিল্ড ছিল ইনজুরির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে সেখানে অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলোতে ক্রিকেটাররা গা বাঁচিয়ে ফিল্ডিং করতেন। সেমিফাইনাল-ফাইনালের আগে ভারতের ইচ্ছেমতো পিচ বানানোর গুরুতর অভিযোগ ওঠে। যা নিয়ে অবশ্য আইসিসি কোনো সমস্যা নেই বলে পরে বিবৃতিতে জানায়।

এশিয়া কাপ নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের স্নায়ুযুদ্ধ

দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত আর পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মুখে দীর্ঘদিন অনিশ্চয়তার মুখে ছিলো এশিয়া কাপের আয়োজন। আগে থেকেই এশিয়া কাপের আসর গড়ানোর কথা ছিল পাকিস্তানের মাটিতে। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে দেশটিতে খেলতে যেতে বিন্দু পরিমাণও রাজি নয় ক্রিকেটের ক্ষমতাধর দল ভারত। সে কারণে কয়েক দফায় বৈঠকের পর হাইব্রিড মডেলে খেলতে রাজি হয় দুই দেশ। সহযোগী হিসেবে ভেন্যু ঠিক হয় শ্রীলঙ্কায়। এরপর ৬ দেশের অংশগ্রহণে এই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসর মাঠে গড়ায়।

এর আগে দু’পক্ষকেই রাজি করাতে তুমুল দোলাচলে থাকতে হয়েছিল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলকে (এসিসি)। তবে ভারত পাকিস্তানে খেলতে না গেলে, পাকিস্তানও ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে রোহিতদের মাটিতে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল অনেকদিন। শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানের মাটিতে না গেলেও, হাইব্রিড মডেলে খেলতে রাজি হওয়ায় নিজেদের সুর নরম করে বাবর আজমদের বোর্ড পিসিবি।

এরপরও কম নাটক হয়নি। এসিসি চেয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই যেন পুরোপুরি হয়, সেজন্য কেবল তাদের ম্যাচে রাখা হয় রিজার্ভ ডে’র ব্যবস্থা। অথচ শ্রীলঙ্কায় হওয়া অধিকাংশ ম্যাচই হয়েছে বৃষ্টির শঙ্কা মাথায় নিয়ে। অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তানের স্নায়ুযুদ্ধের ফল গুনতে হয় প্রতিযোগী সব দেশকেই। সর্বশেষ আসরের ফাইনালে খেলে ভারত ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু স্বাগতিক লঙ্কানরা ন্যূনতম লড়াইও দেখাতে পারেনি মাত্র ৫০ রানে গুটিয়ে যাওয়ায়। মোহাম্মদ সিরাজ একাই নেন ৬ উইকেট। ফলে কোনো উইকেট না হারিয়েই রেকর্ড গড়ে এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব পায় ভারত।

বেসামাল পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট

পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) আর দেশটির সরকার— কেউই পুরো মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারে না বলে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে। সেটি চলতি বছরও বারবার দৃশ্যায়ন হয়েছে পিসিবিতে। রমিজ রাজা ও শহীদ আফ্রিদিরা পিসিবির দায়িত্বে বসার পর, তাদের বিদায়টা সুখকর হয়নি। সর্বশেষ নাজাম শেঠির পর বর্তমানে পিসিবি সভাপতির দায়িত্বে আছেন জাকা আশরাফ। তার নিয়োগও রাজনৈতিক ও বিতর্কিত বলে দেশটির গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।

জাকা আশরাফের অধীনে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর হয়েছিলেন সাবেক তারকা ক্রিকেটার ইনজামাম-উল-হক। এরপর নানামুখী হস্তক্ষেপ ও সমালোচনার জেরে তিনি পদত্যাগের হ্যাটট্রিক হুমকি (তিন দফা) দেওয়ার পর দায়িত্ব ছাড়েন বিশ্বকাপের মাঝপথেই। বিশ্বকাপ শেষে সেই দায়িত্বে বসানো হয়েছে মোহাম্মদ হাফিজকে। এছাড়া প্রধান নির্বাচক করা হয় মাত্র কয়েক মাস আগে অবসর ঘোষণা করা ওয়াহাব রিয়াজকে। সাবেক অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও জুনিয়র ওয়াহাবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি কেউ ভালোভাবে নেয়নি। এরপর স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত সালমান বাটকেও আনা হয়েছিল নির্বাচক প্যানেলে, পরে সমালোচনার মুখে তাকে সরিয়ে দেয় পিসিবি।

এদিকে, লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। যার ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপে লজ্জাজনক পারফরম্যান্সের পর পুরো ক্রিকেট বোর্ডকেই ভেঙে দেয় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয় অন্তর্বর্তীকালীন একটি কমিটিও। কিন্তু ক্রিকেটে সরকারি এমন নাকগলানো দেখে, আরও কড়া সিদ্ধান্ত নেয় আইসিসি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের মেম্বারশিপ বাতিল করেছে। এখনও বহাল থাকা সেই নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আসরও সরিয়ে নেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বিপর্যয়

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম তিন আসরের ফাইনালে, তার মধ্যে শুরুর দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তৃতীয় আসরে তাদের কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিল কপিল দেবের ভারত। ১৯৮৩ সালে লর্ডসের সেই ফাইনালের পর ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অনেককিছু বদলে গেছে। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া সেই দলটি সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা পূরণ করতে পারেনি। বাছাইপর্বের লড়াইয়ে বিশ্বকাপ থেকে তাদের ছিটকে দেয় দুর্বল স্কটল্যান্ড।

বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের গ্রুপপর্বে জিম্বাবুয়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল ক্যারিবীয়রা। সেই সময়ই তাদের বিশ্বকাপে খেলা সংশয়ে পড়ে যায়। তবে তার ষোলোআনা পূর্ণতা দেয় স্কটল্যান্ড। বাছাইয়ের সুপার সিক্সের ম্যাচে তারা ড্যারেন সামির শিষ্যদের ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেয়। এমন করুণ বিপর্যয় দেখে সাবেক অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেন, ‘ওরা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) কত দ্রুত কতটা নিচে নেমে এসেছে, ভাবা যায়!’

টি-টোয়েন্টি সংস্করণ বাদে বর্তমান ক্রিকেটে ক্যারিবীয়দের তেমন দাপট নেই বললেই চলে। অথচ এই উইন্ডিজরাই বিশ্ব ক্রিকেটে কত বাঘা বাঘা কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছে। কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস, ম্যালকম মার্শালের নাম শুনলে এখনও দুঃস্বপ্ন দেখেন ব্যাটাররা। যাদের বাউন্সারের ভয়ে কাঁপতেন সবাই। ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসরা ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করেছেন। ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপ জিতে তার প্রমাণও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু এখনকার কেমার রোচ, জেসন হোল্ডার, আলজারি জোসেফদের নাম মনে রাখতে কষ্ট হতে পারে ক্রিকেট ভক্তদের।

শচীনকে টপকে কোহলির ইতিহাস

পুরো বছরটা দারুণ কেটেছে বিরাট কোহলির। মাঝে দীর্ঘসময় সেঞ্চুরিখরা কাটানো এই মাস্টারব্যাটার দুঃসময় পেরিয়ে এসেছেন। চলতি বছর তিনি ব্যাট হাতে করেছেন দুই হাজার রানের বেশি। এ নিয়ে মোট সাতবার তিনি এই কীর্তি গড়েছেন। যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসেই একমাত্র। মূলত কোহলির বসন্তটা পুরোদমে রাঙিয়েছেন ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক এই ব্যাটার ১১ ম্যাচে ৯৫.৬২ গড়ে করেছেন ৭৬৫ রান। এছাড়া ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা সমান ম্যাচ খেলে ৫৯৭ রান করেন।

বিশ্বকাপে সেরা পারফর্মারদের মধ্যে রাচিন রবীন্দ্রের নাম না বললেই নয়। নিউজিল্যান্ডের বাঁ-হাতি এই অলরাউন্ডারকে লোয়ার অর্ডার ব্যাটারে খেলানোর লক্ষ্য ছিল দলের। কিন্তু তিনি ঘটনাচক্রে বনে যান ওপেনার, এরপর অভিষেক বিশ্বকাপে চার সেঞ্চুরিতে করেছেন ৫৭৮ রান। ১০ ম্যাচে তার গড় ছিল ৬৪.২২। অভিষেক আসর খেলা আরেক কিউই ব্যাটার ড্যারিল মিচেল করেছিলেন ৯ ম্যাচে ৫৫২ রান।

মুম্বাইয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিল ভারত। যেখানে রানতাড়ায় স্বাগতিকদের হয়ে খেলতে নেমে ৫০তম সেঞ্চুরি করেন কোহলি। এবারের বিশ্বকাপেই একাধিকবার এই কীর্তি গড়ার সুযোগ এসেছিল তার সামনে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই গ্রুপপর্বে খেলেছিলেন ৯৫ রানের ইনিংস। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাকে ৮৮ রানে থামতে হয়। শেষ পর্যন্ত নিজের ক্রিকেট আদর্শকে সেমিফাইনালে ছাড়িয়েছেন কোহলি। যা নিয়ে ছুটছেন সবমিলিয়ে শততম সেঞ্চুরির পথে।

চমকের নাম আফগানিস্তান-নেদারল্যান্ডস

চলতি বছর সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে আফগানিস্তান-নেদারল্যান্ডস। রশিদ-মুজিবদের দল আফগানিস্তানের শক্তিমত্তা আগে থেকেই ক্রিকেট মহলে পরিচিত। তবে বিশ্বকাপে তারা যা করেছে, তাতে নতুন করে অবাক বনতে হয়েছে সবাইকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালের লড়াইয়েও ছিল। কাগজে-কলমে তাদের চেয়ে বড় তিন দলকে হারিয়েছে আফগানিস্তান। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তারা যেভাবে জিতেছে, তেমন মানসিকতা শহীদি-গুরবাজদের হারের ম্যাচেও দেখা গিয়েছিল।

তাদের বড় শক্তি ছিল হার নিশ্চিত জেনেও, অকুতোভয় লড়াইয়ের মানসিকতা। বিশ্বকাপের অতিমানবীয় ম্যাচ বলে তকমা পাওয়া ম্যাচটিও হয়েছিল আফগানদের সঙ্গে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এক পায়ে দাঁড়িয়েও তাদের সেমিতে খেলার স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছিলেন। ২৯১ রানতাড়ায় আফগানরা ৯১ রানেই অজিদের ৭ উইকেট তুলে নিয়েছিল। কিন্তু অধিনায়ক কামিন্সকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাক্সওয়েল খেলেন ১২৮ বলে সবচেয়ে দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরির হার না মানা এক ইনিংস।

ভারত বিশ্বকাপে আইসিসির সহযোগী সদস্য একমাত্র দেশ ছিল নেদারল্যান্ডস। তাদের জয়ের পরিমাণ আফগানদের মতো চমক জাগানিয়া না হলেও, তারচেয়ে কম নয়। ক্যারিবীয়দের বিদায় করে তারাই যে বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছিল। এরপর জন্ম দেয় বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনের। উড়ন্ত ফর্মে থাকা প্রোটিয়াদের তারা হারিয়ে দেয়। এরপর জয় পায় বাংলাদেশের বিপক্ষেও।

এএইচএস