একটা লম্বা সময় ছিলেন জাতীয় দলের ওপেনার। এরপর দীর্ঘ নয় বছর হান্নান সরকার ছিলেন বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক হয়ে। তার অধীনেই বাংলাদেশ ক্রিকেট পেয়েছে নিজেদের সেরা দুই সাফল্য। ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপ জয় এবং ২০২৩ সালে যুব এশিয়া কাপ জয়ী দলের নির্বাচকের পদে ছিলেন এই হান্নান। বিসিবির গতকালের (সোমবার) বোর্ড মিটিং এর পর এবার তিনি এসেছেন জাতীয় দলে। 

নির্বাচক পদে আসার পরেই হান্নান সরকার মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা পোস্ট-এর সঙ্গে। আলাপ করেছেন নিজের অভিজ্ঞতা, সামনের চ্যালেঞ্জ এবং আরও অন্যান্য বিষয়ে। উঠে এসেছে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেসহ আরও অনেক প্রসঙ্গই। তার সেই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। 

ঢাকা পোস্ট: শুরুতেই অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনি বেশ অনেকটা সময় ধরেই নির্বাচকের দায়িত্বে আছেন। এবার জাতীয় দলে এলেন। পেছনের অভিজ্ঞতার কথা যদি বলতেন। 

হান্নান সরকার: আমি মূলত যুক্ত হই ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। ৮ বছর ৮ মাস হল। এই ৮ বছর আমি বয়সভিত্তিক দল নিয়েই কাজ করলাম। এরমধ্যে সৌভাগ্যক্রমে আমি দুটা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের নির্বাচক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। ২০২০ (বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয়ের বছর) এবং ২০২৪ বিশ্বকাপ। ২০২০ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলো আর ২০২৩ সালের দলে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হলো। আমি সরাসরি দুটো অনূর্ধ্ব-১৯ দল করার সুযোগ পাই এবং দুটোতেই যথাযথ ফলাফল আসছে। 


ঢাকা পোস্ট: এতদিনের সাফল্যই কী তবে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে?  

হান্নান সরকার: আমার মনে হয়, আজকের বোর্ড সভায়, যেখানে বোর্ডের উর্ধ্বতন সকলেই ছিলেন। বিশেষ করে পাপন ভাই সাউথ আফ্রিকায় সময় করে ফোন দিয়ে মেসেজ করে খবর নিতেন। ওনারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন হয়ত, যার কারণে সম্ভবত মনে হয়েছে, আমার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে কাজ ভাল, তাই আমাকে এখানে নিয়ে আসা (জাতীয় দল) 

আরও একটা বিষয়, হয়ত তারা বিবেচনা করতে পারে। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করলাম ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, যারা খেলল এই সময়। এরাই কিন্তু এখন বাংলাদেশ দলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমনকি ক্যাপ্টেন (মুখে হাসি)। শরিফুল, তানজিম সাকিব এরা আছে। 

ঢাকা পোস্ট: আপনি যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাই এখন জাতীয় দলে। এটা আপনার জন্য সুবিধাজনক কিনা? 

হান্নান সরকার: এটা অবশ্যই আমার জন্য সুবিধাজনক হবে। আমাকে যেমন তাওহীদ হৃদয় ফোন করেছে, তানজিদ তামিম ফোন করেছে। ওরা ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছে। এমনকি বর্তমান অনূর্ধ্ব-১৯ যারা, তারাও রাব্বি, আহরার আমিন থেকে শুরু করে সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। তো এটা আমার জন্য সুবিধা, কারণ ওদের সঙ্গে আমার একটা পার্সোনাল সম্পর্ক আছে, অনেকগুলো ট্যুর করার সুযোগ পাই। একটা ট্যুর করলে সম্পর্ক বাড়ে। বয়সভিত্তিক দলে ট্যুর একটু আলাদা। ওখানে শুধু ক্রিকেট নিয়ে না, ওদের ভবিষ্যত নিয়ে কথা হয়। মাঠ ও মাঠের বাইরের কাজ নিয়ে কথা হয়। ওই গাইডলাইন করার কারণে ওদের সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তো এই জিনিসগুলো আমাকে, এরাই যেহেতু বাংলাদেশ দলে খেলছে, ভবিষ্যতে কাজ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। 

ঢাকা পোস্ট: আগে ছিলেন বয়সভিত্তিক দলে, এবার জাতীয় দল। দায়িত্ব নিশ্চয়ই কিছুটা বেশি

হান্নান সরকার: দায়-দায়িত্বের বিষয়টা কি, এখন তো শুধু বয়সভিত্তিক দল নিয়ে কাজ করব না। তাদের বাইরেও অনেক খেলোয়াড় থাকবে। যারা ঢাকা লিগে ছিল তারা বাংলাদেশ দলে আসতে পারে, ‘এ’ দল বা এইচপি দল বা বিপিএল থেকে আসতে পারে। তাই আমার মনে হয়, এখন আমার দৃষ্টিভঙ্গি একটু আলাদাভাবে দেখতে হবে। তবে হ্যাঁ, যেহেতু ওরা প্রায় সবাই জাতীয় দলে খেলছে, তাই আমার জন্য কাজ করাটা সহজ হবে। যেহেতু তাদের সঙ্গে আমার কিছু ভরসা এবং বোঝাপড়া ভাল। 

ঢাকা পোস্ট: নির্বাচক হতে গেলে অনেকপ্রকার সমালোচনাও সহ্য করতে হয়। পূর্বে আমরা তাইই দেখেছি। এসব নিয়ে কী ভাবছেন? 

হান্নান সরকার: সমালোচনা থাকবেই। সমালোচনা না থাকলে আমি উন্নতি করবো কীভাবে? ভুল করার পর সমালোচনা হলেই তো আমি বুঝতে পারব, আমার ভুল হচ্ছে। তাই আমি এটা নেতিবাচকভাবে দেখি না। সমালোচনা হওয়া খুব স্বাভাবিক।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সমালোচনা বাইরে থেকে করি। কিন্তু ভেতরে যখন নির্বাচকদের মিটিং হয়, তখন নির্বাচকদের অনেক ভাবনা থাকে, সেটা তো আর বাইরের কেউ জানে না। তাই সমালোচনা করাটা সহজ হয়। সেখানে নিশ্চয়ই ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর সমালোচনা হয় ঘটনা ঘটার পরে। তাই ঘটনা ঘটার আগেই আমাদের পরিকল্পনা করতে হয়। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কতটুকু থাকবে, দূরদর্শীতা কতখানি থাকবে তার ওপরে ভিত্তি করেই কিন্তু সমালোচনা হবে। 

ঢাকা পোস্ট: কিছুটা চাপ নিশ্চয়ই এই দায়িত্ব…

হান্নান সরকার: আমি চ্যালেঞ্জ নিতে সবসময় প্রস্তুত। আমি ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছি। বলতে পারেন আমরা (ক্রিকেটাররা) চাপ ছোটকাল থেকেই নিয়ে আসছি। ক্রিকেট খেলতে গেলে তো ছোটবেলা থেকেই চাপ নিয়ে খেলতে হয়। চাপ তো জন্মের পর থেকেই নেওয়া। 

প্রতিটা জায়গাতেই চাপ থাকবে, আর সেটা সামলানোর জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার মনে হয়, এখন পর্যন্ত আমি প্রায় ৯ বছরের কাছাকাছি নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছি, তাই সেই চাপটা কিছুটা হলেও সামলে দেখেছি। যদিও লেভেল ভিন্ন, তবে আমার মনে হয় যে, যদি আমার ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করতে পারি, তাহলে এই চাপ সামলাতে পারব। 

ঢাকা পোস্ট: শান্ত তিন সংস্করণেই অধিনায়ক। সে আপনার অধীনেই খেলেছে যুব বিশ্বকাপে। তাকে কেমন দেখছেন, তার প্রতি আপনার আস্থা কেমন? 

হান্নান সরকার: আমি যখন যুক্ত হই দলের সঙ্গে, তখন ওদের অনূর্ধ্ব-১৯ একেবারে শেষ পর্যায়ে। ওদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক হয়ে ওঠেনি। তবে শান্তর সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা আছে। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয় দেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে। সেই সময় মিনিস্টার রাজশাহী দলে শান্ত ছিল। আমি ছিলাম ওই দলের ম্যানেজার। আর কোচ ছিলেন সরোয়ার ইমরান স্যার। আমরা দুজন মিলেই কিন্তু দল নির্বাচন করি আর যখন অধিনায়কের প্রসঙ্গ আসে, আমরা শান্তকেই অধিনায়ক করি। শান্তর মধ্যে আমরা ওই ব্যক্তিত্ব বা গুণ দেখতে পাই। তার অধিনায়কত্ব আমার কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আছে।    

এই ধরণের দলে যখন সিলেকশন মিটিং হয়, সেরা একাদশ থেকে শুরু করে দল পরিচালনা (তখন অধিনায়ক থাকে)। এসব বৈঠকে যখন তার বিশ্লেষণ দেখতাম, তখন আমার মনে হয়েছিল, তার মধ্যে ওই গুণাবলী রয়েছে। তার সঙ্গে এখন সে পারফর্ম করে যাচ্ছে। এটা তাকে আরও স্ট্রং করবে। শান্তর মধ্যে যে সক্ষমতা আছে, তাতে এটা খুবই যথার্থ সিদ্ধান্ত সে কিছুদিনের জন্য এগিয়ে নেবে। 

হাথুরুসিংহে একটা পদ। সেটা হেডকোচ। এখানে হাথুরুসিংহে থাকুক বা যেইই থাকুক। সে তার দায়িত্ব পালন করবে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। প্রধান নির্বাচক তার দায়িত্ব পালন করবে। তাই আমার মনে হয়, এটা সমস্যা করবে না। অতীতে কি হয়েছে, তা আমি জানিনা। 

ঢাকা পোস্ট: সাকিব আল হাসানকে আর কতদিন আপনি খেলোয়াড় হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন? তার বয়স হয়েছে। চোখের সমস্যার জন্য শ্রীলঙ্কা সিরিজেও তিনি খেলবেন না। 

হান্নান সরকার: আসলে আসন্ন সিরিজ নিয়ে কিছু বলতে পারবো না। কারণ এটার দল আমাদের বর্তমান (পূর্বের) নির্বাচকরা দিয়ে ফেলেছেন। সাকিবের সঙ্গে তারা নিশ্চয়ই পরিকল্পনা করেই দিয়েছে। তবে এরপর থেকে যখন হবে, সাকিবের আপডেট নিয়েই আমরা পরিকল্পনা করব। কারণ সাকিবের রিপ্লেসমেন্ট আমাদের বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি। আমরা তো তাকে অবশ্যই চাই। 

ঢাকা পোস্ট: সাকিব ছাড়াও অন্যান্য সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে কী ভাবছেন? 

হান্নান সরকার: শুধু সাকিব না। সিনিয়র ক্রিকেটার যারা আছে তাদের সবার কথাই বলব। পারফরম্যান্স এবং তারা যদি ফিট থাকে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে তারা যদি ডেলিভারি করার জন্য ফিট থাকে। তাহলে কেন না। আর তাদের বিকল্প আমরা চিন্তা করি।  যদি এমন তৈরি না হয়ে থাকে। তাহলে তো ভিন্নভাবে চিন্তা করা যেতেই পারে। 

আমার মনে হয়, বিষয়গুলো আমরা নির্বাচকরা যখন বসব, তখন আরও জানতে পারব। মূলত তাদের সঙ্গে কি আলোচনা হচ্ছে, বোর্ডের সঙ্গে তাদের কি পরিকল্পনা, সে বিষয়গুলো আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তাই আমি এটা নিয়ে খুব বেশি মন্তব্য করতে চাইনা। তবে শ্রীলঙ্কা সিরিজের পর থেকে যখন আলোচনা করব, তখন থেকে আলোচনায় আনব। 

ঢাকা পোস্ট: হাথুরুসিংহের সঙ্গে অতীতে অনেক নির্বাচকের কথা হয়েছে, তিনি দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন। সেদিক থেকে বাড়তি চ্যালেঞ্জ কিনা?      

হান্নান সরকার: সিলেকশনে লিপু ভাই (গাজী আশরাফ হোসেন লিপু) এসেছেন। রাজ (আব্দুর রাজ্জাক রাজ) তো অনেক আগে থেকেই আছে। এখন হেডকোচের একটা মন্তব্য তো থাকেই। এটা স্বাভাবিক। তার রিকোয়ারমেন্ট আমরা পূরণ করার চেষ্টা করবোই। তারপরেও আমরা নির্বাচকরা যখন বৈঠকে বসব লিপু ভাইসহ, তিনি আমাদের গাইডলাইন দেওয়ার চেষ্টা করবেন আর আমার অপিনিয়ন তো আমি দেওয়ার চেষ্টা করব, এটা বলতে পারি। 

হাথুরুসিংহে একটা পদ। সেটা হেডকোচ। এখানে হাথুরুসিংহে থাকুক বা যেইই থাকুক। সে তার দায়িত্ব পালন করবে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। প্রধান নির্বাচক তার দায়িত্ব পালন করবে। তাই আমার মনে হয়, এটা সমস্যা করবে না। অতীতে কি হয়েছে, তা আমি জানিনা। কারণ সেখানে আমি ছিলাম না। পরবর্তীতে যখন থাকব, তখন পরিস্থিতি সে অনুযায়ী দেখব। আমি আশাবাদী আমরা এই নির্বাচক প্যানেল, খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।  

জেএ