ধারাবাহিক প্রতিবেদন : পর্ব-২
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ : আছে আইন, নেই বাস্তবায়ন
বাংলাদেশের সব ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের অভিভাবক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সকল ক্রীড়া স্থাপনার মালিকানাও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের। ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নানা অসঙ্গতি, দুর্বলতা ও সংকটের বিষয়গুলো নিয়ে ধারবাহিক প্রতিবেদন করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।
দ্বিতীয় পর্বে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অ্যাক্ট, ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশন নীতিমালা, জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন/এসোসিয়েশন নির্বাচন নীতিমালার (২০১৩) প্রয়োগহীনতার পাশাপাশি আইনগুলোরও সীমাবদ্ধতাও চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
৫০ বছরে ৩৭ ফেডারেশন/এসোসিয়েশন, নেই জন্মের ইতিহাস
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বীকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ফেডারেশন বা এসোসিয়েশন গঠিত হয়। আক্ষরিক অর্থে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোর অভিভাবক। কিন্তু অভিভাবকের কাছে এমনকি সন্তানের (ফেডারেশনের) জন্ম পরিচয়ের প্রকৃত সময়ও সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ নেই বলে অভিযোগ আছে। কোন সালে, কোন সময়ে কোন ফেডারেশন বা এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি ঠিকঠাক লেখা নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সচিব আকতার হোসেন খান বলেন, 'জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোন ফেডারেশন কবে জন্ম হলো এই তথ্য থাকা উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে এই সংক্রান্ত কোনো তালিকা নেই।'
১৯৭২ সাল থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যক্রম চলমান থাকলেও এটি মূলত পরিচালিত হয়ে আসছে ১৯৭৪ সালের এনএসসি অ্যাক্ট অনুযায়ী। সেই অ্যাক্টে একটি তালিকায় রয়েছে ১৮ ফেডারেশনের নাম। সেগুলো হচ্ছে- অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, শরীর গঠন, দাবা, সাইক্লিং, জিমন্যাস্টিক্স, ফুটবল,হকি, জুডো,লন টেনিস, শুটিং, রোইং, সাঁতার, ভলিবল, ভারত্তোলন, কুস্তি ও ক্রিকেট।
বিজ্ঞাপন
১৯৭৪ সালের এনএসসি অ্যাক্ট সংশোধিত হয়েছে ২০১৮ সালে। সেই অ্যাক্টে ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের তালিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪৮। অ্যাক্টে ৪৮ থাকলেও গত ছয় বছরে আরও সাতটি (কান্ট্রি গেমস, সেপাক টেকরো, চুকবল,থ্রো বল, জুজুৎসু,প্যারা আরচ্যারি ও খিউকিশিন) এসোসিয়েশন স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫-তে। ১৯৭৪ সাল থেকে এই ৫০ বছরে আরও ৩৭ টি নতুন করে গঠিত হয়েছে।
প্রচলিত ও জনপ্রিয় খেলা ছাড়াও অনেক ফেডারেশন রয়েছে বাংলাদেশে। যেগুলোর জাতীয় পর্যায়ে তেমন প্রচলন ও আন্তর্জাতিক সফলতাও নেই। এমন অনেক খেলা এবং ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম হয়েছে তদবিরের মাধ্যমে। আবার অনেক সময় বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও এসব ফেডারেশন গড়ে তোলার সঙ্গে জড়িত থাকেন।
চল্লিশ বছর পর স্বীকৃতির নীতিমালা, এরপরও নেই প্রয়োগ
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অ্যাক্টের ৫ ধারায় ক্রীড়া সংস্থা ও স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থার স্বীকৃতি প্রদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পরিষদ, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্রীড়া সংস্থাকে জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি ও সনদ প্রদান করিতে পারিবে’। অ্যাক্টে এই আওতা থাকলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দীর্ঘদিন ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনকে স্বীকৃতি প্রদানের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেনি। সাবেক দুই তারকা ফুটবলার ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক বাদল রায় ও দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার পর তারাই মূলত এই নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ‘জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন/এসোসিয়েশন এর স্বীকৃতি প্রদান নীতিমালা’ তৈরি করেন।
এই নীতিমালায় ফেডারেশনকে চারটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। এ-বিশেষ, এ, বি ও সি। ফেডারেশনের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট খেলা বা সংস্থাকে এসোসিয়েশনের স্বীকৃতি পেতে হবে। এসোসিয়েশন প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ জেলা ও নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লাবের অংশগ্রহণে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এবং জুনিয়র প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে। এই রকম কর্মকাণ্ড কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে করার পর সি ক্যাটাগরির ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
ফেডারেশন বা এসোসিয়েশন স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদনকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র, সাধারণ পরিষদ, অফিস, প্রয়োজনীয় লোকবল, স্থাপনা, খেলার চিত্র, আর্থিক সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় থাকা আবশ্যক। নীতিমালায় ফেডারেশনের ক্যাটাগরি ভিত্তিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আর্থিক অনুদান বণ্টনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
নীতিমালাটি বেশ যুগোপযোগী হলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অবশ্য বাস্তবায়ন করে না। নীতিমালায় প্রথম অনুচ্ছেদেই রয়েছে ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের মূল্যায়ন। প্রথম অনুচ্ছেদের খ ধারায় রয়েছে ‘প্রতি চার বছর মেয়াদান্তে মূল্যায়ন সাপেক্ষে ফেডারেশন/ এসোসিয়েশনকে মান উন্নয়ন/মান অবনমন করণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যা ক্রীড়া উন্নয়নে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি করবে।’
নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে প্রায় এক দশক হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই বার এই মূল্যায়ন হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ফেডারেশনগুলোর পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হয়নি। এই নীতিমালার ৯ নম্বর ধারায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্বাহী কমিটি কিংবা সাধারণ পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে যথাযথ কারণ দর্শানো সুযোগ দিয়ে স্বীকৃতি প্রাপ্ত যে কোনো ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনকে বাতিল করার এখতিয়ার ক্রীড়া পরিষদ সংরক্ষণ করে।
তদবির ও চাপেই ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের স্বীকৃতি
প্রচলিত ও জনপ্রিয় খেলা ছাড়াও অনেক ফেডারেশন বা এসোসিয়েশন রয়েছে বাংলাদেশে। যেগুলো জাতীয় পর্যায়ে তেমন চর্চা নেই, আবার নেই আন্তর্জাতিক সফলতাও। এমন অনেক খেলা এবং ফেডারেশন/এসোসিয়েশনের জন্ম হয়েছে তদবিরের মাধ্যমে। আবার অনেক সময় বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও এসব ফেডারেশন গড়ে তোলার সঙ্গে জড়িত থাকেন। ফলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের পক্ষে অনেক অনুরোধ বা চাপ অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না।
বিশেষ করে কারাতে কেন্দ্রিক অনেকগুলো ফেডারেশন থাকলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সর্বশেষ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এসোসিয়েশন খিউকুশীন কারাতে এসোসিয়েশন। এটির সভাপতি ছিলেন সেই সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী দীপু মণি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এটি বেশ কয়েক বছর আটকে রাখলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বীকৃতি দিতে অনেকটা বাধ্য হয়।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল ওবায়েদ (অব) প্রায় বছর বছর ফেডারেশন/এসোসিয়েশন স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে রাজনৈতিক প্রভাবকেই সরাসরি ইঙ্গিত করে বলেন, ’আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মান সংখ্যক ফেডারেশনই ছিল ক্রীড়াঙ্গনে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক মন্ত্রীর সময় যে কয়টি ফেডারেশন জন্ম হয় আরেক মন্ত্রী এসে সেটা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রতি সরকারের মেয়াদেই কোনো না কোনো ফেডারেশন/এসোসিয়েশনের জন্ম হয়েছে গত তিন দশকে।’
চাপে বন্ধ নির্বাচন, বদলে যায় ভোট সেন্টার; ভোট বাক্সশূন্য
১৯৯৮ সাল থেকে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে নির্বাচন প্রথা শুরু হয়। ফেডারেশনগুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদই এই নির্বাচন করে থাকে। ফিফার বাধ্যবাধকতার জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বাফুফে নির্বাচন ছাড়া অন্য সকল ফেডারেশনের নির্বাচনই সম্পাদন করে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলার কথা ফেডারেশনগুলোর, সেখানে উল্টো ফেডারেশনগুলোর চাপে নতনাজু থাকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
সম্প্রতি ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে মতভেদ ছিল। মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্যন্ত সমঝোতা না হওয়ায় দুই পক্ষ চেয়েছিল নির্বাচন স্থগিত করতে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এতে অনড় ছিল। ভোটের দিন ব্যাডমিন্টন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নজিরবিহীন কাণ্ড করেন। ভোটকেন্দ্রে প্রায় সবাই উপস্থিত থাকলেও কেউ ভোট দেয়নি। নির্বাচন কমিশনার শূন্য বাক্স নিয়ে যেতে হয়। যা ক্রীড়া গণতন্ত্রে কালো দিবস হিসেবে বিবেচিত।
দাবা ফেডারেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়েছিল। মনোনয়ন পত্র সংগ্রহের পর সেই তফসিল আকস্মিকভাবে স্থগিত হয়। এক্ষেত্রেও অনেকটা ব্যাডমিন্টনের মতো সাধারণ সম্পাদক নিয়ে মতভেদ থাকায় ক্রীড়াঙ্গনের তৎকালীন প্রভাবশালীরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নির্বাচন তফসিল বন্ধ করে।
ভোট বাক্স শূন্য, তফসিল স্থগিতের মতো ভোট কেন্দ্র পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে।
২০১৭ সালের হকির নির্বাচন ছিল অত্যন্ত আলোচিত। ফুটবল ছাড়া প্রায় সকল ফেডারেশনের নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র মূলত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবন। ২০১৭ সালের হকি ফেডারেশনের নির্বাচনেও তাই ছিল। নির্বাচনের ২-১ দিন আগে আকস্মিকভাবে ভোট কেন্দ্র বদলে হয়ে যায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থায়। বাহ্যিক চাপে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ন্যুব্জ হওয়ার অন্যতম উদাহরণ এটি।
নিষিদ্ধ দ্বৈত নাগরিকও আছেন ফেডারেশনে
ফেডারেশন/এসোসিয়েশন স্বীকৃতি নীতিমালার মতো ক্রীড়া ফেডারেশন নির্বাচন নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রেও দুই সাবেক তারকা ফুটবলার বাদল রায় ও দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন নির্বাচন নীতিমালা প্রণীত হয়। সেই নীতিমালায় ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিলর এবং প্রার্থী পদের অযোগ্যতা’ খ এবং গ উপধারায় রয়েছে যথাক্রমে ‘তিনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক না হন’ এবং ‘তিনি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্বসহ দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন’।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। ক্রীড়াঙ্গনেও তদ্রুপ আইন রয়েছে। আইন থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই। দ্বৈত নাগরিক অনেকেই ফেডারেশনগুলোতে বর্তমানে আছে এবং অতীতেও নানা পদে ছিল। সাবেক তারকা ফুটবলার আবদুল গাফফারের বিদেশি পাসপোর্ট রয়েছে, যা ক্রীড়াঙ্গনে সবারই জানা। দ্বৈত নাগরিক হয়েও তিনি সাইক্লিং ফেডারেশনের কমিটিতে আছেন।
গত পাঁচ বছর বিভিন্ন ফেডারেশনের নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক প্রশাসন শেখ হামিম হাসান। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ফেডারেশনগুলোর নির্বাচন আরও স্বচ্ছ করতে হলে আমাদের সফটওয়্যার ভালো প্রয়োজন। অনেক সময় এক ব্যক্তি কয়েকটি ফেডারেশনের কাউন্সিলর থাকেন। সেগুলো ডাটাবেজ থাকলে সহজেই ধরা যেত। দ্বৈত নাগরিক শনাক্তের জন্য মনোনয়ন ফরমও পরিবর্তন প্রয়োজন।’
ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনে মনোনয়নপত্রে প্রার্থীর স্থায়ী নিবাস নিয়ে একটি ঘর রয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দ্বৈত নাগরিকত্ব কাউন্সিলরশীপ ও প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে রাখলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনয়ন পত্রে নাগরিকত্ব, বিদেশে বসবাস নিয়ে কিছুই নেই।
হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম ভাড়া, এনএসসির চোখে কাঠের চশমা
দেশের সকল ক্রীড়া স্থাপনার মালিকানা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। বিভিন্ন ফেডারেশন খেলা পরিচালনা, অনুশীলনের জন্য স্ব স্ব স্থাপনা ব্যবহার করতে পারে। সেই সকল স্থাপনা অন্যত্র ভাড়া বা ভিন্ন কোনো কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফেডারেশনকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম যেন ব্যতিক্রম। হ্যান্ডবল ফেডারেশন নিজেদের ইচ্ছে মতো স্টেডিয়াম ভাড়া দিয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এর জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমতি নেয়ও না আবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও তাদের কোনো জবাবদিহি করে না।
হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম প্রায় প্রতি শুক্রবারই বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া হয়। বিভিন্ন ব্যাংক, কর্পোরেট, প্রতিষ্ঠান মূলত ফুটসাল টুর্নামেন্টের জন্য হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম ব্যবহার করে। এর বিনিময়ে হ্যান্ডবল ফেডারেশন ভালো অর্থই আয় করে। হ্যান্ডবল ফেডারেশনের এই ভাড়ার প্রক্রিয়া ও এর উপযোগিতা নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে প্রশ্ন রয়েছে অনেক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনেক কর্মকর্তারা বিষয়টি জ্ঞাত হলেও অজ্ঞাত কারণে যেন নিশ্চুপ!
স্বল্প বরাদ্দ, নেই অফিস-অনুশীলন ভেন্যু, নেই জবাবদিহিতাও
ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের সংখ্যা ৫৫। এর মধ্যে প্রায় ১৫টির নির্দিষ্ট কার্যালয় বা কোনো অফিস নেই। আবার অনেক ফেডারেশনের অফিস থাকলেও নেই অনুশীলনের পর্যাপ্ত ভেন্যু। এর চেয়েও বড় সমস্যা আর্থিক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা সেই অর্থে দিতে পারে না। বাৎসরিক যে অনুদান প্রদান করে সেটা প্রশাসনিক ব্যয়তেই মূলত শেষ হয়। মানুষের পাঁচটি যেমন মৌলিক অধিকার তেমনি ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর মৌলিক অধিকার ফেডারেশন অফিস, অনুশীলন ভেন্যু, প্রয়োজনীয় অর্থ। অভিভাবক হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সেই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা দায়িত্ব। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেই অধিকার নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফেডারেশনগুলোর কাছে প্রকৃত জবাবদিহিতাও চাইতে পারে না।
ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের সংখ্যা ৫৫। এর মধ্যে প্রায় ১৫টির নির্দিষ্ট কার্যালয় বা কোনো অফিস নেই। আবার অনেক ফেডারেশনের অফিস থাকলেও নেই অনুশীলনের পর্যাপ্ত ভেন্যু। এর চেয়েও বড় সমস্যা আর্থিক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা সেই অর্থে দিতে পারে না।
অনেক ফেডারেশন কর্মকর্তা খেলাকে ব্যবহার করে বাণিজ্য করছে। আবার অনেক ফেডারেশনে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে প্রচুর। আদমপাচার, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাও শোনা যায় মাঝে মধ্যে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নিয়মিত ভিত্তিতে এই বিষয়গুলো তদারকি করে না কখনো। মিডিয়ায় কোনো বিষয় এলে তখন তদন্ত কমিটি বা পর্যালোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এনএসসি কর্তারাই ফেডারেশনে
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশন বা এসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ড তদারকি বা পর্যবেক্ষণ করবে। উল্টো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তারাই ফেডারেশনগুলোর নানা পদে আসীন হন। এতে জবাবদিহিতার মাত্রা আরও কমে দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। ফুটবল ছাড়া বাকি সব ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দু’জন করে কর্মকর্তা সরাসরি মনোনীত করতে পারে। এটা সাধারণত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যারা খেলা ও ফেডারেশনে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতেন সেই রকম লোক মনোনয়ন হতো আগে।
এক যুগের বেশি সময় এই কোটায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অফিসাররাই বেশি মনোনীত হয়ে আসছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অফিসাররা মনোনীত হন অফিসের স্বার্থে, সেটা তর্কের খাতিরে গ্রহণযোগ্য হলেও অনেকেই আবার নির্বাচনও করেন। যা খানিকটা স্বার্থের সংঘাতের মধ্যেও পড়ে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ফেডারেশনে বিভিন্ন পদে থাকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের সেই সকল পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
ফেডারেশনগুলো অনেক কষ্টে বিদেশে দল প্রেরণ করে। সেই দল প্রেরণের সময় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এজন্য অনেক বেগ পোহাতে হয় ফেডারেশনকে। এই প্রক্রিয়া সহজ করতে অনেক ফেডারেশন মাঝে মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাকে দলের সঙ্গে খরচ দিয়ে নিতে বাধ্য হন। সরকারি অনুমতি ছাড়াও অর্থ ছাড় আরও আনুষাঙ্গিক বিষয়ে ফেডারেশনগুলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মুখাপেক্ষী। সেই সকল কাজ সহজতর এবং ঝামেলা এড়াতে অনেক ফেডারেশন এনএসসি কর্মকর্তাদের সৌজন্যমূলক সফর প্রদান করে।
ক্রিকেট বোর্ড যেন ‘অন্য গোত্র’
ক্রিকেট বোর্ড অন্য দশটি ফেডারেশনের মতোই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনস্থ ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্রীড়া সংস্থা। বিগত এক যুগ ক্রিকেট বোর্ড অনেকটা নিজেদের মতোই চলছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে ছিল অনেকটা ‘পোস্ট অফিস’ টাইপ। খুব প্রয়োজনে চিঠি-পত্রাদি চালাচালি হয়েছে। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, নব্বইয়ের দশকেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচই ছিলেন বিসিবির প্রধান ভরসা।
ক্রিকেট বোর্ড এনএসসির সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও এনএসসি কোনো জবাবদিহিতা চাইতে পারেনি সেভাবে। সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ক্রিকেট বোর্ডকে অবাধ্য সন্তান হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। ক্রিকেট, শুটিং ছাড়া দেশের বাকি ফেডারেশন সব বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকায়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বিভিন্ন কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডে অন্য সকল ফেডারেশন আসলেও ক্রিকেট বোর্ড থাকত অনুপস্থিত।
১৯৯১ সালের মন্ত্রীপরিষদ আইন অনুযায়ী স্টেডিয়ামের গেটমানি থেকে ফেডারেশনগুলো ১৫ শতাংশ অর্থ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে প্রদান করবে। গত দেড় যুগে বিসিবি টিকিট বিক্রি করে অনেক অর্থ আয় করেছে। অথচ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেখান থেকে লেভী আদায় করতে পারেনি প্রাপ্য হিসাবে। অসংখ্য চিঠি দিলেও বিসিবি কর্ণপাত করে না। টিকিটের গেটমানি ও প্রচার স্বত্ত্ব নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিসিবির কাছে কয়েক কোটি টাকা পাওনা দাবি দীর্ঘদিন ধরেই।
সময়ের প্রেক্ষাপটে অবশ্য চিত্র বদলেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এখন ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে অনেকটাই নতজানু। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশন বা ক্রীড়া সংস্থার অভিভাবক। দলীয় সরকারের সময় এটা মূলত কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দেশের দুই শীর্ষ খেলা ফুটবল ও ক্রিকেটের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকে না মূলত। বাকি ফেডারেশনগুলোর ওপরও কর্তৃত্ব খুব একটা থাকে না। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ক্রীড়া সংগঠকদের প্রভাবে অন্য ছোটখাটো ফেডারেশনে প্রকৃত নজরদারি অনেক সময় করতে পারে না। সামরিক শাসন ও নির্দলীয় সরকারের সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দৃঢ়তা বেশি প্রকাশ পায় ক্রীড়াঙ্গনে।
কমিটি ভাঙার ক্ষমতা
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অনেক আইন থাকলেও বাস্তবায়ন করে না। আবার প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাই প্রদর্শন করে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তার অ্যাক্ট অনুযায়ী ( ২০১৮ পূর্বতন ১৯৭৪) যে কোনো ফেডারেশনের যেকোনো কমিটি ভাঙার এখতিয়ার রাখে। ১৯৯৮ সাল আগ পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র কিংবা নির্বাচনী ব্যবস্থা ছিল না। সেই সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অ্যাডহক কমিটির ভিত্তিতেই ফেডারেশনগুলো চলেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা আসার পরও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তার সেই ক্ষমতা বহাল রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে অ্যাডহক কমিটি গঠন হচ্ছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক সংগঠক পলাতক, জেলে এতে তেমন প্রশ্ন আসছে না। তবে স্বাভাবিক সময়েও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সঙ্গে ফেডারেশন কর্মকর্তাদের দূরত্ব বা যে কোনো ইস্যুতে নির্বাচিত কমিটি ভাঙার সুযোগ থাকছেই। যা ক্রীড়াঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম অন্তরায় মনে করেন ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট অনেকেই। বিগত সময়ে নির্বাচিত কমিটি ভাঙায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে অনেক আইনি জটিলতায় পড়তে হয়েছে।
এনএসসি অ্যাক্ট সংশোধন প্রয়োজন
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দীর্ঘদিন ১৯৭৪ অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে কিছুটা সংশোধন করে ২০১৮ অ্যাক্ট পাশ হয়েছে। যদিও ৭৪ অ্যাক্ট থেকে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্রীড়াঙ্গন যুগপযোগী করতে এনএসসি অ্যাক্ট সংশোধন খুবই প্রয়োজন মনে করেন ক্রীড়া সংগঠক সিরাজউদ্দিন আলমগীর, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নিজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে আগে। এজন্য তাদের নির্বাহী কমিটির আকার ও গঠন ঠিক করা প্রয়োজন। এক সভায় এক ফেডারেশনের প্রতিনিধি আরেক সভায় আরেক ফেডারেশন থাকে। এতে ধারাবাহিকতা যেমন থাকে না তেমনি জবাবদিহিতাও থাকে না। অ্যাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে ফেডারেশনগুলোর সভাপতি পুরোপুরি নির্বাচিত হওয়া প্রয়োজন। পুরো কমিটি নির্বাচিত সভাপতি শুধু মনোনীত এটিও অসামাঞ্জস্য। কারণ সভাপতি/মনোনীত থাকায় সরকার তাদের দলীয় ব্যক্তিদেরকেই সভাপতি মনোনয়ন করে রাজনৈতিকরণ করে থাকে।’
এজেড/এফআই/জেএস