শততম টেস্টের আগে মুশফিককে নিয়ে হাবিবুল বাশার
‘বাংলাদেশের মিস্টার ক্রিকেট মুশফিকুর রহিম’
২০০৫ সালের ২৬ মে দিনটা মনে গেঁথে থাকারই কথা মুশফিকুর রহিমের। ঐতিহাসিক লর্ডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার। সেই থেকে পথচলা শুরু লাল বলের ক্রিকেটে। সময়ের হিসেবে ইতোমধ্যে দুই দশক পার হয়ে গিয়েছে। এবার জাতীয় দলের হয়ে শততম টেস্ট খেলার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন জাতীয় দলের এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার।
আগামী ১৯ নভেম্বর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে শততম টেস্টে নামবেন মুশফিক। তার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুশফিকের প্রথম অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন জানালেন তাকে নিয়ে নানা অজানা কথা। স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নেওয়া সেসব গল্প শুনলেন ঢাকা পোস্টের ক্রীড়া প্রতিবেদক সাকিব শাওন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট :১০০ টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন মুশফিক, আপনি তার প্রথম অধিনায়ক হিসেবে নিশ্চয়ই গর্বিত?
বাশার: শুধু আমি একা না, পুরো বাংলাদেশ আজ গর্বিত। প্রথম টেস্ট ম্যাচটা ওর সাথে আমরা খেলেছিলাম, এখন দুইদিন পরে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামবে। আসলে এমন অর্জনে শুধু আমি না পুরো বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : মুশফিক যখন প্রথম দলে ডাক পেয়েছিল, মনে আছে কি সেই দিনের কথা?
বাশার: ঠিক দিন তারিখ হিসেব করলে আসলে ওইভাবে মনে নেই। তবে আমরা শুনেছিলাম মুশফিকের কথা যে একটা উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান আসতে যাচ্ছে। খুব ভালো তার সাউন্ড এবং টেকনিক। তারপর যখন আসলো তখন তো আসলে অনেক ছোট ছিল, বয়স কম। প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল যে এর অনেক বয়স কম। প্রথমে কিপার হিসেবে এসেছিল পরে তার সঙ্গে ব্যাটসম্যান হিসেবে জায়গা করে নেয় দলে। মুশফিকের দলে আসার খবর প্রথমে শুনেছিলাম নির্বাচক ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকে।
ঢাকা পোস্ট : লর্ডসে অভিষেক হবে মুশফিকের, এমন চিন্তা করেই কি দলে নেওয়া হয়েছিল?
বাশার: না, তেমন কিছু চিন্তা করে আসলে দলে নেওয়া হয়নি। আমরা ইংল্যান্ডে লম্বা সময়ের জন্য সফর করছিলাম তো আমাদের একজন দ্বিতীয় উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান দরকার ছিল। তখন পাইলট ছিল আমাদের মূল কিপার। দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে মুশফিককে দলে আনা হয়েছিল। ওখানে ম্যাচ খেলার আগে আমরা কিছু কাউন্ট্রি ম্যাচ খেলেছিলাম সেখানে মুশফিক অনেক ভালো করেছিল একটা ম্যাচে। তখন সবাই খুব প্রশংসা করেছিল।
ঢাকা পোস্ট : মুশফিককে প্রথম দেখায় কেমন মনে হয়েছিল?
বাশার: তাকে প্রথম দেখেই যদি বলে দিতাম যে বিশ্বমানের ক্রিকেটার হবে তাহলে তো ভুল হতে পারত আবার সঠিকও হতে পারত। তবে তখন প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল যে একটা ছেলে আসছে ভালো। মুশফিকের প্রতি প্রথম ইম্প্রেশনই ছিল যে ব্যাটিংটা ভালো করবে।
ঢাকা পোস্ট : অভিষেকে তো বেশি রান করতে পারেনি...
বাশার: দেখেন ওর অভিষেকের বিষয়টা ওরকম কিছু না আর কি। ওই ম্যাচে তাকে দলে নেওয়া হয়েছিল কিপার হিসেবে। তবে এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল যে শুরু থেকে সাহস ছিল তার ভেতরে।
ঢাকা পোস্ট : আপনি কি বিশ্বাস করেছিলেন মুশফিক ১০০ টেস্ট খেলতে পারবে?
বাশার: এটা বলা কিন্তু তখন কঠিন ছিল। কারণ আমরা এত টেস্ট ম্যাচ খেলি না যে আমাদের একজন ক্রিকেটার ১০০ টেস্ট খেলবে। এটা অনেক বড় ব্যাপার আমাদের দেশের জন্য। আমাদের কোনো ছেলে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলবে, শুধু কিন্তু ভালো ক্রিকেটার হলেও হবে না। এটা অনেক বড় ব্যাপার, আমরা ভেবেছিলাম যে ছেলেটা ভালো করবে।
ঢাকা পোস্ট : প্রথম কয়েক বছর তো খুব বেশি ভালো করতে পারেনি, এরপর ডমিনেট শুরু করে
বাশার: খুব খারাপ কিন্তু করেনি আর কি। আমরা শ্রীলঙ্কাতে একটা সিরিজে গিয়েছিলাম, সেখানে ভালো করেছিল। ওই যে বললাম না যে কিছু খেলোয়াড় আছে যাদের দেখলে বোঝা যায় কয়েক ম্যাচ খারাপ খেললেও তারা ভালো করতে পারবে। খেলার ধরণ দেখলে বুঝতে পারি আমরা যে আসলে কে ভালো করবে। মুশফিককে দেখেই মনে হতো যে ভালো খেলবে যে কারণে ওর ওপর দল কখনো আস্থা হারায়নি।
ঢাকা পোস্ট : আপনি যখন অধিনায়ক ছিলেন কেমন দেখতেন আর যখন নির্বাচক হলেন তখন কি আলাদা কিছু দেখেছেন?
বাশার: সে অনেক কমিটেড এবং ডিটারমাইন্ড। একদম শুরু থেকে যেরকম আসলে সবাই থাকে সে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত এবং দলে থিতু হওয়ার চেষ্টা করত। যতদিন গেছে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের একটা বড় সুবিধা হলো ওর দলে থাকাটা, দলের ব্যাটিং গভীরতাটা বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকা পোস্ট : মুশফিকের অধিনায়কত্ব কেমন দেখেছেন?
বাশার: না দেখেন ওর রেকর্ড কিন্তু খুব খারাপ না যতদিন অধিনায়কত্বে ছিল। আমি বলব যে মুশফিকের অধীনে বড় বড় দলের বিপক্ষে টেস্ট জিতেছি। সিরিজও ভালো করেছে সেগুলো কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না।
ঢাকা পোস্ট : আরো বেশি দিন অধিনায়কত্ব চালিয়ে যেতে পারতো কি না...
বাশার: দেখেন অধিনায়কত্বটা কে করবে কে করবেন না এটা ডিপেন্ড করে কিন্তু তার নিজের ওপর। সেই অধিনায়কত্ব কে কতটুকু এনজয় করছে, না হলে অধিনায়ক হলে চাপও রয়েছে। আমাদের দেশে আরও বেশি কঠিন। কেউ যদি এনজয় না করে তাহলে তার জন্য অধিনায়কত্ব করাটা কিন্তু কঠিন। মুশফিকের কাছে বা আমাদের কাছে কিন্তু তার পারফরম্যান্সটা সবচেয়ে ওপরে। সে অধিনায়ক থাকার চেয়ে কিন্তু নিজের পারফরম্যান্সকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : পরিশ্রমী মুশফিকের মতো কি আর কেউ আসবে দেশের ক্রিকেটে
বাশার: মুশফিক তো একটা উদাহরণ সেট করে গেল এখন বাকিদের কাজ। সকল ক্রিকেটারের জন্য সে একটা বেঞ্চমার্ক সেট করে দিয়ে গেল। আমার মনে হয় মুশফিকের পরিশ্রম নিয়ে অনেক কথা হয় কিন্তু আমি দেখি ওর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা। এটা আমার কাছে বেশি গুরুত্ব মনে হয়।
ঢাকা পোস্ট : ২০ বছর আগে মুশফিক আর আজকের মুশফিককে কিভাবে বর্ণনা করবেন...
বাশার: বিশ বছর আগের মুশফিক থেকে কিন্তু এখনকার মুশফিক অনেক বেশি পরিণত। পরিবর্তন তো অনেকের মধ্যেই হয়। তার যে আগ্রহ খেলার প্রতি যে ভালোবাসা রয়েছে শুরুর দিন ও যেমন ছিল আজও তেমন রয়েছে, বরং আরো বেড়েছে।
ঢাকা পোস্ট : আপনি তো লম্বা সময় ধরে তাকে চেনেন। তার পরিবারের সাথেও ভালো সম্পর্ক আছে...
বাশার: বগুড়ায় যখন যেতাম তখন মুশফিকের বাসায় দাওয়াত থাকতো। সবাই এনজয় করতাম, যে কারণে তার পরিবারের সবার সাথে চেনা জানা। মুশফিকের থেকে ওর বাবার সাথে বেশি কথা হতো আর কি। তারা খুব বেশি ভাবতো না, তারা কেবল খেলা দেখতে ভালোবাসতো। খেলাটা তারা এনজয় করেন, তারা মুশফিককে খেলতে দেখতে ভালোবাসেন।
ঢাকা পোস্ট : মুশফিকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তেমন কোনো বিতর্ক নেই এটা কিভাবে দেখেন?
বাশার: এত লম্বা ক্যারিয়ার এত সফল ক্যারিয়ার। বিতর্ক কথাটা আমি বলবো না, কেবল বলবো যে ওর মতো পারফর্মার খুব ডিফিকাল্ট আসলে। মুশফিকের নাম আসলে ওর নামের সাথে ক্রিকেট শব্দটা খুব ভালোভাবেই যায়। আপনি ওকে বাংলাদেশের মিস্টার ক্রিকেট বলতে পারেন।
ঢাকা পোস্ট : মুশফিকের আর কত বছর খেলা চালিয়ে যাওয়া উচিত হবে?
বাশার: এই প্রশ্নটা আসলে ওঠা উচিত না আমি আসলে এটার জন্য কম্ফোর্টেবল মনে করি না। মুশফিক আর কত বছর খেলবে এটা সম্পূর্ণ তার ওপর। সে জেনুইন পারফর্মমার। একটা কথা বলতে পারি মুশফিক দাঁড়িয়ে থাকলে বাকিদের জন্য সহজ হয়ে যায়। অন্য যারা আছে তারা কনফিডেন্ট পায় তাকে দেখে। তো ওর চিন্তাটা ওকে করতে দিন।
ঢাকা পোস্ট : খেলা ছাড়ার পর তাকে কোন প্রফেশনে দেখতে চাইবেন ?
বাশার: আমি জানি না ও আসলে কোচিংয়ে আসবে কি না। ওর ক্রিকেটীয় ব্রেনটা খুব ভালো। প্রশাসনেও আসতে পারে। যেহেতু ওর ক্রিকেট ব্রেনটা ভালো, যেটাই এনজয় করবে সেটাই আসুক। তবে আমার মনে হয় সে কোচিং করলে ভালো করবে।
এসএইচ/এফআই