যুব বিশ্বকাপ হকিতে বাংলাদেশ ৫ ম্যাচ খেলেছে এখন পর্যন্ত। পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই হ্যাটট্রিক করেছেন আমিরুল ইসলাম। পাঁচ ম্যাচের পাচটিতেই গোল করেছেন। ১৫ গোল করে যুব বিশ্বকাপ হকির এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তিন ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন। বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদের এমন সাফল্য রীতিমতো অবিস্মরণীয় কীর্তি। 

বাংলাদেশের হকির সঙ্গে স্বাধীনতার আগে থেকেই জড়িত কিংবদন্তী আব্দুস সাদেক। তিনি আমিরুলের পারফরম্যান্সকে বাংলাদেশের হকির অন্যতম সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, 'বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোনো বৈশ্বিক আসরে খেলছে। সেই টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচে আমিরুল সেরা এবং তিনি পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই হ্যাটট্রিক করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের হকির অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।’

সাবেক প্রয়াত খেলোয়াড় জুম্মন লুসাই বিশ্ব হকির একাদশে প্রীতি ম্যাচে খেলেছিলেন। জামাল হায়দার ও মামুনুর রশীদের এশিয়ান একাদশে খেলার কীর্তি রয়েছে। তবে নিজেদের অর্জন ও স্বীকৃতির চেয়েও আমিরুলকে এগিয়ে রাখছেন দেশের হকির অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ও কোচ মামুনুর রশীদ, 'জুম্মন দা বিশ্ব হকি, আমি ও জামাল ভাই এশিয়া হকির একাদশে থাকলেও আমিরুলের পারফরম্যান্স আমাদের চেয়ে কোনো অংশ কম নয়, বরং আরো বেশি। কারণ তিনি বিশ্বকাপে তিন ম্যাচ সেরা ও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা। এতেই তিনি আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছেন।'

বিশ্ব হকির নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফআইএইচ বছরের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশ করে। আমিরুলের নাম সেখানে আসার সম্ভাবনা দেখছেন মামুন, 'আমিরুলের যে পারফরম্যান্স সে বিশ্বের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হিসেবে আসার মতই। একমাত্র তারই ১৫ গোল স্পেনের এক জনের নয় গোল রয়েছে বাকি দুই ম্যাচে ৬ গোল করা কঠিনই।’

আমিরুল ইসলাম মূলত ডিফেন্ডার। পেনাল্টি কর্নার থেকে তিনি গোল করেন। বাংলাদেশ হকির পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট হিসেবে মামুনুর রহমান চয়ন, আশরাফুল ইসলাম, সোহানুর রহমান সবুজের পর এখন আমিরুলের ইসলামের নাম উচ্চারিত। দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করা মামুনুর রহমান চয়ন আমিরুলকে নিয়ে বলেন, 'আমিরুল পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট হিসেবে দারুণ করছে। যা এখন আশরাফুলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমি যখন খেলেছি তখন নিয়ম ছিল টানা তিন গোল হলে হ্যাটট্রিক। এখন ম্যাচের যে কোনো সময় তিন গোল হলেই হ্যাটট্রিক। এই নিয়ম আমি পেলে আমারও অনেক হ্যাটট্রিক হতো। আমিরুল পেনাল্টি কর্নারে বেশ দক্ষ সেটা তার পেনাল্টি কর্নার থেকে গোলে রুপান্তরের হার থেকেই স্পষ্ট। বিশ্বের সেরা গোলরক্ষককের বিপক্ষে একাধিক গোল করেছি। আমি চাই সে আমাকে ছাড়িয়ে যাক।'

ফরিদপুরের সন্তান আমিরুলের হকি খেলোয়াড় হয়ে উঠা মূলত বিকেএসপি থেকেই। বিকেএসপির প্রধান হকি কোচ জাহিদ হোসেন রাজু আমিরুলকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার সম্পর্কে রাজু বলেন, 'আমিরুল পেনাল্টি কর্নার নিয়ে অনেক অনুশীলন করত। অনুশীলনের আগে ও পরে আলাদাভাবে সে প্রতিদিন ৫০-১০০ ফ্লিকও করেছে অনেক দিন। আশরাফুল-সবুজদের দেখে তার ধ্যানজ্ঞান ছিল ভালো ফ্লিক মাস্টার হওয়ার। একাগ্রতায় সে সফল হয়েছে।'

জাতীয় দলের সাবেক তারকা খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামাল। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক গোল ও কীর্তি রয়েছে তার। আমিরুলের পারফরম্যান্স সবাইকে ছাপিয়ে গেছে সরাসরি বললেন এই সাবেক খেলোয়াড়, 'একজন হকি খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছে আমিরুল। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে বাংলাদেশের কেউ টানা হ্যাটট্রিক ও ম্যাচ সেরা হতে পারে। তার এই পারফরম্যান্স আমি মনে করি বাংলাদেশের হকির অন্য সব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে।’

বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি এশিয়া কাপ ও এশিয়ান গেমস খেলার কীর্তি রাসেল মাহমুদ জিমির। ২০১৩ সালে ভারতে ওয়াল্ড হকি সিরিজ লিগে সেরা মিডফিল্ডারের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন হকির এই কিংবদন্তী। আমিরুলকে নিয়ে জিমির অবশ্য একটু ভিন্ন মত, 'আমিরুল আমার সঙ্গে মোহামেডানে খেলেছে এবং পেনাল্টি কর্নারের দক্ষতা সম্পর্কে অবগত। বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্সে আমরা সবাই খুশি এবং অবশ্যই বাংলাদেশের হকিতে অনেক বড় সাফল্য। তার বয়স একুশের কম, সামনে অনেক বড় সময় রয়েছে। সিনিয়র জাতীয় দলেও তার কাছে প্রত্যাশা থাকছে, সিনিয়র পর্যায়ে পারফরম্যান্সের পর সিনিয়রদের বিগত তুলনা বেশি যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।'

যুব টুর্নামেন্ট হলেও বৈশ্বিক মঞ্চে টানা হ্যাটট্রিক ও ম্যাচ সেরা বিশাল কৃত্তিত্ব। এমন পারফরম্যান্সের পর বিশেষ সম্মাননা ও পুরস্কার আমিরুলের প্রাপ্য মনে করেন চয়ন, 'আমিরুল যেটা করেছে এজন্য সে বাড়ি/ফ্লাট ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বা সরকার থেকে প্রাপ্য। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড়ের এই পারফরম্যান্স রীতিমতো অবিশ্বাস্য।’ জাতীয় দলের সাবেক দুই অধিনায়ক আব্দুস সাদেক ও রফিকুল ইসলাম কামাল দুই জন অবশ্য আশার আলো দেখছেন অন্যত্র, 'তার এই পারফরম্যান্স বিশ্বের সকল দেশই দেখেছে। আশা করি সামনে বড় কোনো দেশের কোনো বড় কোনো লিগে সে অফার পাবে।’

জাতীয় দলের সাবেক কোচ মামুনুর রশীদ খানিকটা আফসোস করে বলেন, 'আমিরুলের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পরও বাংলাদেশের মিডিয়া ও ক্রীড়াঙ্গনে তেমন বিশেষ কোনো আলোচনা নেই। যা বেশ পীড়াদায়ক। ফুটবল, ক্রিকেটের পরই তৃতীয় দলীয় খেলা এখন হকি। বিশ্বকাপে এমন খেলার পরও সেভাবে মিডিয়ায় আলোড়িত হয়নি। '

এজেড/এইচজেএস