প্রিমিয়ার লিগের পথে টেপ টেনিসে খেলা ঠাকুরগাঁওয়ের ইকবাল
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রাম। যেখানে ধুলোমাখা মাঠ আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলাই জীবন। এই গ্রামের মাটিতে বেড়ে ওঠা ইকবাল হোসেন আজ জাতীয় ক্রিকেটের মঞ্চে নাম লেখাতে চলেছেন। বাইশ বছরের এই তরুণ ক্রিকেটারের গল্প শুধু খেলার নয়, এটি পরিবারের সংগ্রাম, গ্রামের বাস্তবতা এবং অদম্য স্বপ্নের গল্প।
ইকবাল হোসেন শহিদুল ইসলাম ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে। বাবা দিনভর মাঠে কৃষিকাজ করেন আর মা বাড়ির পাশের ছোট চায়ের দোকান চালান। গ্রাম্য জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং কঠোর পরিশ্রমই ছিল এই পরিবারের প্রতিদিনের বাস্তবতা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ইকবাল বড়, ছোট বোন স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। গ্রামে সাধারণ জীবন, সীমিত সুযোগ, কিন্তু চোখে বড় স্বপ্ন এই ছিল ইকবালের গল্পের শুরু।
বিজ্ঞাপন
ইকবালের ক্রিকেট শুরু হয় গ্রামের মাঠেই। টেপ টেনিস বল হাতে খেলা, ভাঙা ব্যাটে ব্যাটিং, কখনো খালি পায়ে- এভাবে কাটিয়েছেন তিনি শুরুর দিনগুলো। খেলার সময় পারপুগী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে এক বড় ভাই তার খেলা দেখেন। ইকবালের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে তিনি পরামর্শ দেন নিয়মিত ক্রিকেট একাডেমিতে অনুশীলন করার। বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম, কিন্তু পরিবার পাশে দাঁড়ানোর কারণে ইকবাল থেমে যাননি।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালে ইকবাল অনূর্ধ্ব-১৮ ডিভিশনে খেলার সুযোগ পান। সেই বছরের শুরু থেকেই নিয়মিত ক্রিকেট প্র্যাকটিসে মন দেন। ২০২১ সালে বয়সভিত্তিক ডিভিশন ক্রিকেটে অংশ নেন। তবে বয়সের সীমার কারণে ডিভিশন পর্যায়ের ক্রিকেট শেষ হয়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকেননি ইকবাল। লক্ষ্য ঠিক ছিল ঢাকা লিগে খেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছানো।
ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতির সময় রাশেদ ইকবাল ও কোচ রোকুনজ্জামান রাহাতের সহযোগিতায় ঢাকায় একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে অনুশীলনের ব্যবস্থা হয়। থার্ড ডিভিশন থেকে শুরু হয়। কঠোর পরিশ্রম এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের ফলে সেকেন্ড ডিভিশনে উঠে যান। সেখানে অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার পর প্রথম ডিভিশনে সুযোগ পান। প্রতিটি পর্যায়ে নিজের খেলা দিয়ে কোচ এবং সতীর্থদের মন জয় করেন। ভালো খেলার কারণে জাতীয় ক্রিকেট রিজিয়ন (এনসিআর) থেকে ডাক আসে রংপুর ডিভিশনের প্রাথমিক স্কোয়াডে। টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে শুরু থেকেই ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে দলের চ্যাম্পিয়ন হয়। গ্রামের ছেলে হিসেবে দলের ভরসা হয়ে ওঠেন তিনি। এখন লক্ষ্য প্রিমিয়ার লিগ। সেই লক্ষ্য নিয়েই চলছে কঠোর প্রস্তুতি।
স্থানীয় ভগদগাজী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং শিবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন ইকবাল হোসেন। বর্তমানে একই কলেজে ডিগ্রি পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনা আর ক্রিকেট দুই ক্ষেত্রেই তিনি সমান মনোযোগী।
প্রতিবেশী তারেক আলী বলেন, ‘ইকবালকে ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মাঠে ব্যাট-বল নিয়ে খেলছে। অন্য ছেলেদের মতো খেলতে খেলতে তার মধ্যে আলাদা কিছু ছিল। গ্রামের ছেলে হলেও সে অন্যদের থেকে বেশি পরিশ্রমী আর মনযোগী। আমরা গর্বিত যে আমাদের গ্রামের ছেলে জাতীয় ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছে।’
প্রতিবেশী হুমায়ন রেজা বলেন, ‘ছেলেটা খুব শান্ত ও নম্র। গ্রামের মাঠে খেলার মধ্যে থেকেই তার এই জেদ ও ধৈর্য এসেছে। আমরা আশা করি ইকবাল আরও বড় জায়গায় পৌছাবে এবং গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে।’
নূর হোসেন নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘ইকবাল ছোটবেলা থেকেই আলাদা প্রতিভা দেখাত। শুধু খেলার আনন্দ নয়, প্রতিদিন অনুশীলন করতে দেখতাম। তার পরিবার তাকে সবসময় সমর্থন করেছে। এমন ছেলে আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে।’
ইকবালের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা খুব ভালো করত। আমরা ভাবতাম, খেলা মানে শুধু সময় কাটানো, কিন্তু দেখলাম ছেলেটার মধ্যে এক ধরনের জেদ আর আগ্রহ আছে। আমরা অনেক গর্বিত। শুধু এতটুকু বলতে পারি, ছেলেটা পড়াশোনা আর খেলা দুটোই মন দিয়ে করুক, পরিশ্রম চালিয়ে যাক। আমাদের সামর্থ্য কম, কিন্তু ছেলে কিছু করতে চাইলে আমরা পাশে আছি।’
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে শুধু খেলেছি আনন্দের জন্য। গ্রামের মাঠ, টেপ টেনিস বলে সবকিছু আমার শুরু। এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম খেলাটা শুধু মজা নয়, এটাও একটি সুযোগ বড় কিছু করার। বাবা-মা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার লক্ষ্য এখন জাতীয় পর্যায় এবং ভবিষ্যতে প্রিমিয়ার লিগ খেলা। আমি জানি, সহজ হবে না, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু আমি থামব না। প্রতিদিন অনুশীলন করি, চেষ্টা করি নিজের খেলার মান উন্নত করার।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ঠাকুরগাঁও জেলা ক্রিকেট কোচ রোকুনজ্জামান রাহাত বলেন, ‘ইকবাল হোসেনের মধ্যে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও ধৈর্য আছে। ছোটবেলা থেকেই মাঠে তাকে নিয়মিত অনুশীলন করতে দেখেছি। শুধু প্রতিভা নয়, তার মনোভাবও চমৎকার। গ্রামের ছেলে হলেও তার খেলা জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর মতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই ইকবাল যেন আরও ভালো খেলে। জাতীয় ক্রিকেটে উজ্জ্বল নাম করুক। সে যদি নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যায়, ভবিষ্যতে প্রিমিয়ার লিগ পর্যন্ত পৌছানো তার জন্য অসম্ভব নয়। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা তার পাশে আছি।’
রেদওয়ান মিলন/এফএইচএম