বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজন হয় না দীর্ঘদিন। পাঁচ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগে সবশেষ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হয়েছিল ২০১৭ সালে। দুই দলের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় কালেভদ্রে। এবার প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি সিরিজে মুখোমুখি টাইগার-অজিরা। কুড়ি ওভারের এই ফরম্যাটের সিরিজে আধিপত্য দেখিয়ে জিতেছে বাংলাদেশ। মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে পরিসংখ্যান আর রেকর্ড; সবখানেই দাপট মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দলের।

বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ আয়োজনে টালবাহানা নিত্য সঙ্গী অস্ট্রেলিয়ার। নিরাপত্তা অজুহাতে এর আগে বেশ কয়েকবার সিরিজ স্থগিত করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। যুব বিশ্বকাপে দল না পাঠানোর মতো ঘটনারও জন্ম দিয়েছে তারা। তবে এবার করোনাভাইরাস শঙ্কা মাথায় নিয়েই বাংলাদেশ আসে অজিরা। এর কারণ অনুসন্ধানে নামলে উঠে আসে দুটি বিষয়। 

এক, চলতি বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল ভার‍তে। শেষপর্যন্ত সেটি ভারতে না হলেও ওমান আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে মাটিতে বসবে। সেখানকার আবহাওয়া আর উইকেটের চরিত্রে কিছুটা হলেও মিল আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। বিশ্বকাপের পূর্ব প্রস্তুতি সারতেই অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ খেলতে রাজি হয় বলে গুঞ্জন আছে। 

দুই, আগামী বছর শ্রীলঙ্কা সফর আছে অস্ট্রেলিয়ার। সঙ্গে পাকিস্তান আর ভারত সফর করবে অজিরা। এই তিন সিরিজে চোখ তাদের। মূলত ভারতের বিপক্ষে সিরিজে দৃষ্টি রেখেই বাংলাদেশ সফরে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। মন্থর উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন অ্যাস্টন এগার, মিচেল সোয়েপসনরা। উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে স্লোয়ার কিভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটিও বেশ ভালোভাবে পরখ করে গেলেন জস হেইজেলউড, নাথান এলিসরা।

অস্ট্রেলিয়া দল বাংলাদেশ সফরে আসার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মাথায় উপর একাধিক শর্তের বোঝা চাপিয়ে দেয়। তাদের শর্ত মেনে পাঁচতারকা একটি গোটা হোটেল ভাড়া করে বিসিবি। হোটেলে অস্ট্রেলিয়া দলের জন্য আলাদা জিমের ব্যবস্থা করা, তাদের সুইমিংপুলও আলাদা করে ক্রিকেট বোর্ড। এমন কি অজিদের শর্তের জন্য মাঠে খাবার পর্যন্ত নিতে পারে না বাংলাদেশ দল। গ্যালারিতে বল গেলে সে বলে আর খেলা হয়নি।

সফরকারীদের সব শর্তই মেনে নয় বিসিবি। চাওয়া একটাই, করোনাভাইরাস মধ্যে সিরিজটি সফলভাবে শেষ করা। সেদিন বিবেচনায় সফল বিসিবি। সফলতা মিলিছে মাঠের ক্রিকেটেও। বিশ্ব ক্রিকেটে বেশ নামডাক অস্ট্রেলিয়ার। তারা ক্রিকেট মোড়লদের একজন। বলা যায় বাইশ গজের সবচেয়ে সফল দল তারা। অথচ তাদেরই কিনা রীতিমতো মাটিতে নামাল বাংলাদেশ। পাঁচ ম্যাচ সিরিজে কোণঠাসা করে সিরিজ জিতে নিয়েছে ৪-১ ব্যবধানে।

দলীয় পারফরম্যান্সের সঙ্গে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও বাজিমাত টাইগার ক্রিকেটারদের। ব্যাটিং বিভাগে সেরা ৫ জনের ৪ জনই বাংলাদেশি। অস্ট্রেলিয়ার মিচেল মার্শ ৫ ম্যাচে ১৫৬ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তালিকার বাকি ৪ জন; সাকিব আল হাসান (১১৪), আফিফ হোসেন (১০৯), নাঈম শেখ (৯১) ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (৯১)। 

মন্থর উইকেটে ব্যাটসম্যানরা তাদের ব্যাটিং প্রদর্শনী ঠিকঠাক করতে পারেননি। গোটা সিরিজে যে দুটি ফিফটি এসেছে তার একটি রিয়াদের, অন্যটি মার্শের। এর মধ্যে চতুর্থ ম্যাচে সাকিব আল হাসানকে এক ওভারে ৫টি ছক্কা হাঁকিয়ে আলোচনায় অজি ব্যাটসম্যান ড্যান ক্রিস্টিয়ান। সেদিনই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে খরুচে বোলিং করেন সাকিব। ৫০ রান দিয়ে থাকেন উইকেট শূন্য।

বোলিং বিভাগেও বাজিমাত টাইগার বোলারদের। সেরা ৫ জনের ৪ জনই বাংলাদেশি। স্পিন বিষে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের যেমন নীল করেছেন নাসুম আহমেদ-সাকিবরা, তেমনি কাটার স্লোয়ারে বাজিমাত মুস্তাফিজুর রহমান আর শরিফুল ইসলামের। ৫ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক নাসুম। ৮ উইকেট নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে জশ হেইজেলউড। ৭টি করে উইকেট নিয়েছেন শরিফুল, মুস্তাফিজ ও সাকিব। ব্যাটে-বলে অবদান রাখার জন্য সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠে সাকিবের হাতে।

এ সিরিজে অভিষেকে ইতিহাসে নাম তোলেন অজি পেসার নাথান এলিস। সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে মাঠে নেমেই হ্যাটট্রিক করেন তিনি। টি-টোয়েন্টি ইতিহাস এর আগে হ্যাটট্রিক হয়েছে ১৬টি। বাংলাদেশের বিপক্ষেই এসেছে তিনটি। কিন্তু অভিষেকে হ্যাটট্রিকের অর্জন একটিও ছিল না এর আগে। এ তালিকায় এলিসই হয়ে থাকলেন প্রথম।

সিরিজে এমন রেকর্ড হয়েছে বেশকিছু। যেমন পাঁচ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৬২ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৬০ রানের বিশাল জয়ই তুলে নেয় টাইগাররা। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৯ এতদিন ক্যাঙ্গারুদের সর্বনিম্ন টি-টোয়েন্টি স্কোর হলেও সেটি পিছনে পড়ে যায়। এই ৬০ রানের জয় রানের হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় জয়, সবার উপরে ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৭১ রানে পাওয়া জয়টি।

এই ম্যাচে মাত্র ১৩ ওভার ৪ বলে অলআউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। এর আগে এতো কম ওভারে অলআউট হয়নি অজিরা। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ ওভার ৩ বলে অলআউট ছিল তাদের লজ্জার রেকর্ড।

এই সিরিজে ১৩২, ১২৮ এমন কি ১২৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমেও জিততে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। এর আগে এতো কম রানের টার্গেটে ব্যাট করে হারের নজির ছিল না তাদের।

রেকর্ড বইতে অস্ট্রেলিয়া দল লজ্জার সঙ্গী হলেও বাজিমাত করেন সাকিব। কুড়ি ওভারের ফরম্যাটে হাজার রানের গণ্ডি আগেই পার করেছেন টাইগার অলরাউন্ডার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মাঠে নামার আগে ৯৮ উইকেটের মালিক ছিলেন তিনি। এদিন খেলতে নেমে বল হাতে ছড়ি ঘোরান এই বাঁহাতি স্পিনার। মাত্র ৯ রান দিয়ে তুলে নেন ৪ উইকেট। এতে ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব। এতে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের মালিক বনে গেলেন সাকিব।

টিআইএস/এটি