কোথায় যেন ছন্দপতন; কোনোকিছু ঠিকঠাক চলছে না তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট! অনুশীলনে, মাঠে এমনকি সংবাদ সম্মেলন কক্ষেও চেনা মুখগুলো কেমন যেন অচেনা! কোনো কথা বা সমালোচনা কিছুই হজম করতে পারছেন না ক্রিকেটাররা। হাসিমুখের জায়গায় কথাবার্তায় কেমন যেন ঔদ্ধত্য ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গি! মাহমুদউল্লাহ থেকে মুশফিক, জাতীয় দলের ক্রিকেটার প্রায় সবাই! 

বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। রোববার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা হারের পর মুশফিকুর রহিম শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে এসে যা বললেন, সেটাও ঠিক চেনা মুশফিকের মেজাজের সঙ্গে যায় না। 

বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম ম্যাচটা তো জিততেই পারত বাংলাদেশ। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ভুল ক্যাপ্টেন্সি আর লিটন দাসের দুটো সহজ ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় সব সর্বনাশ। ৫ উইকেটে ম্যাচ হেরে মাঠ ছাড়ল টাইগাররা।

এরপর যদি তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আর জবাবে মুশফিকের মতো একজন সাবেক অধিনায়ক যদি সমালোচকদের ‘আয়নায় নিজেদের মুখ’ দেখতে পরামর্শ দেন-তখন বিস্মিত না হয়ে উপায় আছে? তবে বিশ্বকাপ মিশন শুরুর আগে-পরের কিছু দৃশ্যপট যদি জানা থাকে তবে নিশ্চয়ই টাইম লাইনটাও মেলাতে পারবেন। গত কিছুদিন ধরেই ক্রিকেটের শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে আমজনতা যেমন সমালোচনায় মুখর, তেমনি ক্রিকেটাররাও বেশ সরব। ছেড়ে কথা বলছেন না! মাঝখান থেকে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে দেশের ক্রিকেট।

সমালোচকদের পরামর্শ দিয়ে মুশফিক বলছিলেন, ‘যারাই এমন কথা বলেন, তাদের নিজেদের মুখটা একটু আয়নায় দেখা উচিত। কারণ, তারা বাংলাদেশের হয়ে খেলে না, আমরা খেলি। শুধু আমি না, ১৬ বছর ধরে যারা খেলছেন কিংবা তারও আগে থেকে, যারা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগেও খেলেছেন, সবাই কিছু করার চেষ্টা করেছেন। কোনো দিন হয়, কোনো দিন হয় না। তবে দিনের শেষে আমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করি, আমাদের কাছে সবচেয়ে গর্বের বিষয় এটি।’

নিশ্চয়ই জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা গর্বের ব্যাপার। সবার সেই যোগ্যতা নেই, সৌভাগ্যও হয় না। কিন্তু তাই বলে ক্রিকেটাররা ভুল করলে, মাঠে বাজে পারফরম্যান্স হলে তা নিয়ে দুটো কথা বলা যাবে না? বাংলাদেশের মানুষদের ক্রিকেট আবেগটা তো জানাই আছে ক্রিকেটারদের। দুবাই-শারজায় এসে সেটা আরও একবার দেখলাম। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েও সাকিব-মুশফিকদের খেলা দেখবেন বলে ছুটে এসেছেন অনেকে। কেউ আবার বেতন কাটা যাবে জেনেও চলে এসেছেন মাঠে। 

রক্ত-ঘামে অর্জিত দিরহাম খরচ করে খেলা দেখতে এসে সেই প্রবাসী দর্শকরা যদি দুটো কথা বলেই থাকেন, তাদেরও কি আয়নায় মুখ দেখতে বলবেন মুশফিক? এটা তো ভুললে চলবে না, কিছু জায়গায় আমরা সেই তিমিরেই দাঁড়িয়ে। সিনিয়র কয়েকজন ক্রিকেটার ছাড়া বাকিরা সুযোগের পর সুযোগ পাচ্ছেন কিন্তু ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি। অভিষেকের অর্ধযুগ পেরিয়ে গেলেও তাদের নিয়ে আগ্রহের সীমা নেই নির্বাচকদের!

টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি বাড়াতে দেশের মাঠে ডেকে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারানোতে কতটা কী লাভ হয়েছে সেটা তো ওমান-আমিরাতেই দেখছি আমরা। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের আগে অনুশীলন ম্যাচের দুটিতেই হারল দল। মূল পর্বে স্কটল্যান্ডের কাছে হার। এবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আসল লড়াইয়ে অনেক ভুলের জন্ম দিয়ে পথ হারানো!

যেখানে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কিছু সিদ্ধান্তকে তো প্রশ্নবিদ্ধ করাই যায়! সাকিব আল হাসান যখন সাফল্য পাচ্ছিলেন, তখন কিনা তাকে বোলিং থেকে দূরে রাখলেন। আবার যখন নিয়ে আসলেন তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আবার নিজেও চলে আসলেন বোলিংয়ে। আফিফ হোসেনকেও যে ম্যাচের সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কেন বোলিংয়ে আনলেন! সঙ্গে লিটন দাসের দুটো ক্যাচ মিস তো আছেই। যার কল্যাণেই ম্যাচ জিতে মাঠ ছেড়েছে লঙ্কানরা।

ঠিক এই অবস্থাতেও কি একটু সমালোচনা করা যাবে না? কাঠগড়ায় তোলা না হোক- কেউ লিটন দাসকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না? যিনি ক্যারিয়ারের অর্ধযুগ পেরিয়েও সেই সম্ভাবনার কোটায় খেলে যাচ্ছেন, সুযোগ পাচ্ছেন একের পর এক ম্যাচ!

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন বড় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে চারপাশ। একটু সমালোচনাও সহ্য হয় না! অথচ অন্য যে কোনো দেশে এরচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানে। আর ক্রিকেটারদের এটা তো ভুলে গেলে চলবে না তারা এখানে কেউ বিনামূল্যে চ্যারিটি ওয়ার্ক করতে আসেননি। পেশাদারি জগতে এমন আবেগী হয়ে কথা বলার সুযোগ আছে? প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।

অবশ্য তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কেউ তো আর ইচ্ছে করে খারাপ খেলে না। কিন্তু পারফরম্যান্সের উন্নতি করতে হবে। মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়ে মাঠের বাইরে তাদের কথার খই ফুটানোটাও বন্ধ করতে হবে। দেশের ক্রিকেটের যারা সামান্য খোঁজ রাখেন তারা জানেন ক্রিকেট কিছু জায়গায় থমকে আছে। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম কিংবা মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া অন্যরা কেন বিশ্বমানের হতে পারছেন না? 

কেউ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, এগিয়ে যাওয়ার তাড়নাটাও কোথায় যেন কর্পূরের মতো উবে যায়! নিজেদের আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার মানসিকতা আছে কি না সেই প্রশ্নটাও তো ঘুরপাক খাচ্ছে! একটা বিশ্বকাপ মিশনে দল, যেখানে গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মুশফিক-রিয়াদরা। সেই তারাই যখন সমালোচক-ভক্তদের আয়নায় মুখ দেখতে বলেন, তখনই বোঝা যায় মাঠের বাইশ গজের ক্রিকেটের চেয়ে অন্যদিকেই তাদের ফোকাস বেশি। 

জাতীয় দলের হয়ে খেলে যে আনন্দ ও সুখ পান মাহমুদউল্লাহরা, মাঠের বাইরে গ্যালারির এক কোনায় অথবা বাসার টিভি সেটের সামনে বসে বাংলাদেশের জার্সি পরা সমর্থকরাও তখন একই গর্বে গর্বিত। সেই সমর্থক হয়তো মাঠে খেলার সুযোগ পান না, কিন্তু হাতে দোলানো বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে তিনিও এই দলের অংশীদার, অন্যতম দাবিদার!

মাঠের বাইরে অনেক কথাই উঠবে। কিন্তু মাঠের বাইরে সেই কথার তর্কে জিতে তো আপনি বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে ফিরতে পারবেন না। বিশ্বকাপে ভাল করতে হলে ক্রিকেটারদের শুধু মাঠেই খেলতে হবে। জিততে হবে সেখানেই। 

পরের ম্যাচের আগে মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকরা এখন এটা জানলেই হয়!

এটি/টিআইএস/জেএস