মাহমুদউল্লাহর এমন চেহারা যেন টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলেরই একটা প্রতীকী ছবি/গেটি ইমেজ

কথায় আছে, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়। তেতো হয়ে গেলে আর খাওয়ার উপায় থাকে না। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গল্পটাও বোধ হয় একই রকম হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে হার, টানা তিন ম্যাচে জয় নেই। সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নেরও কার্যত মৃত্যু হয়ে গেছে। মাঠ আর মাঠের বাইরের বিতর্কে ক্রিকেট যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এমন দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপের গল্প কখন ফুরাবে কে জানে!

সুপার টুয়েলভে ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পরের ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। আবুধাবির শেখ জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ম্যাচটি খেলার পর মাঝে একদিন বিরতি। তারপর ৪ নভেম্বর দুবাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ। ওই ম্যাচ দিয়েই শেষ হবে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের বিশ্বকাপ অভিযান। সামনের দুই ম্যাচে যাই হোক, এবার একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-  টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা এখনো ঠিক সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ যুগ পেরিয়ে গেছে এই ফরম্যাটে। কিন্তু কিছুতেই যেন খেলাটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি টাইগাররা।

মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবই হয়েছে, শুধু মাঠের খেলাটাই ঠিকঠাক হয়নি। দেশের শীর্ষ ক্রিকেট কর্তা থেকে শুরু করে ক্রিকেটার, সমর্থক এমনকি তারকাদের স্ত্রীরাও নানা মন্তব্য করে জড়িয়েছেন বিতর্কে! সমস্যাটা কোথায়? কেন এভাবে তলানিতে দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট? বিশ্বকাপ অভিযান কী করে এমন দুঃস্বপ্নে রূপ নিল- এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে ঢাকা পোস্ট। কথা বলেছে দেশের দুজন নামি ক্রিকেট বিশ্লেষকের সঙ্গে।

নতুন কিছুই চিন্তা করতে হবে
মোহাম্মদ ইসাম 
বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইএসপিএন-ক্রিকইনফো

বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি যেটা খেলে সেটা ওয়ানডে ক্রিকেটের একটা ফর্ম, ওয়ানডে ক্রিকেটের একটা ভার্সন নিয়ে তারা খেলে। এটাই আমার কাছে খুব আজব লাগে। এত বছর ধরে টি-টোয়েন্টি ঘরোয়াভাবে খেলছে, ১৫ বছর ধরে ন্যাশনাল ক্রিকেটে খেলছে, এখনো এক্সাক্টলি টি-টোয়েন্টি কী, সেটা বুঝতে পারছে না! শুধু প্লেয়ার বা কোচরা না, আমাদের ক্রিকেট যারা চালায়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড- আসলে সব লেভেলেই ঘাটতি। 

আপনি যদি প্লেয়ারদের কথা চিন্তা করেন। তাদের অনেক আগে এই ফরম্যাটটা আয়ত্ত করা উচিত ছিল। তাদের অনেক অনেক আগেই টি-টোয়েন্টিটা বোঝা উচিত ছিল। আসলে কী দরকার এই ফরম্যাটে খেলতে হলে। বোলার, ব্যাটসম্যান বা ফিল্ডার বলেন, শেখার ব্যাপারে অনেক ধীরগতি। 

যদি আপনি কোচদের কথা বলেন, তারা আসে শুধু কিছু জয় পেতে। তারা ভালো করেই জানে বাংলাদেশ শুধু ওয়ানডে ক্রিকেটেই ভাল খেলে। সেটাতেই তাদের বেশি ফোকাস থাকে। যা আমরা দেখি, টি-টোয়েন্টিতে তারা যা কথা বলে, তারা যেসব জিনিস আলাপ আলোচনা করে, আসলে বলার জন্য বলা। খুব একটা ফোকাস তাদের থাকে না টি-টোয়েন্টিতে। 

আর কর্তৃপক্ষের কথা যদি বলেন, যারা ক্রিকেট চালায় তাদের তো একসময় টি-টোয়েন্টি নিয়ে এলার্জি ছিল। সেই এলার্জি থেকে তারা সরতেই পারেনি। এখন দেখে মনে হচ্ছে যে টি-টোয়েন্টিকে আমরা তাড়া করছি, আমরা জানি না কী করে এই ফরম্যাটে আমরা ভাল করব। খারাপ খবর হচ্ছে আগামী বছরই আরেকটি বিশ্বকাপ। একটা থেকে বের না হতেই আরেকটা। 

আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল স্কটল্যান্ড, ওমান এবং পাপুয়া নিউগিনির (পিএনজি) খেলা দেখা। বাছাই পর্বে তাদের বিপক্ষে তিনটা ম্যাচের কথা চিন্তা করে দেখেন, স্কটিশদের কাছে বাংলাদেশ হেরেছে। ওমানের কাছে অনেক কষ্ট করে জিতেছে এবং পিএনজির সাথে বাংলাদেশ একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত চালকের আসনে ছিল, এরপর কিন্তু ওরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওদের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা না বাংলাদেশের সাথে। 

আর মূল পর্বে বড় দলগুলোর সাথে যে এমনটা হবে এটা অনেকেই ধারণা করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও ধারণা করেছিলাম যে বড় দলগুলোর সঙ্গে ম্যাচ খুবই ডিফিকাল্ট হবে বাংলাদেশের জন্য। কারণ শ্রীলঙ্কা হয়তো বাংলাদেশের লেভেলের দল। কিন্তু ওয়েস্টইন্ডিজ আর ইংল্যান্ড বলুন, সব হচ্ছে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, টি-টুয়েন্টিতে। বাংলাদেশ হয়তো ওয়ানডেতে ওদের মাঝে-মধ্যে হারায়। 

এটা তো বিশ্বকাপ, অনেক কিছু বলাই যায়। হাবিবুল বাশারের কথা শুনলাম, উনার কথাগুলো শুনে ভাল লাগল, অন্তত কেউ একজন সত্য কথাগুলো বলল। এদিক সেদিক ব্লেম না করে এটাই করতে হবে। কাউকে ব্লেম করার কিছু নেই, ব্লেমটা সবার। সবার মাথায় ব্লেমটা নিয়ে নতুনভাবে একটা কিছু চিন্তা করতে হবে। আসলেই একটা নতুন কিছুই চিন্তা করতে হবে। এখন আর শর্টকাট খুঁজে লাভ নেই!

সমালোচনাটাও হজম করতে জানতে হবে
এম. এম কায়সার
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিং বিডি

আমার তো মনে হয়, বাংলাদেশ দলে সমস্যার শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই। বিশ্বকাপ দলে ওপেনিং ব্যাটসম্যান কে হবেন- সেই প্রশ্নে অধিনায়ক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে তামিম ইকবাল মূলত অভিমান করেই নিজেকে সরিয়ে নিলেন। যার প্রভাব বিশ্বকাপের মাঠে পড়তে দেখেছি আমরা। 

তামিম ভেবেছেন টিম ম্যানেজমেন্ট এবং অধিনায়কই যখন আমাকে চায় না তাহলে আমি খেলবোই বা কেন? ওপেনিংয়ে তামিম না থাকায় প্রতি ম্যাচেই আমরা নার্ভাস ভঙ্গিতে ইনিংস শুরু করেছি। ওপেনিং জুটি জমেনি। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাটিং লাইনআপে। তামিম খেললেই যে এই অনিশ্চয়তা কেটে যেত, তার গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আপনি স্বেচ্ছায় তৈরি করা এই সঙ্কট নিয়ে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে আসবেনই বা কেন?

প্রথম ম্যাচে আমরা যখন অপ্রত্যাশিতভাবে স্কটল্যান্ডের কাছে হারলাম, তখন চারপাশ থেকে এত বেশি সমালোচনা শুরু হয়েছিল, ক্রিকেটাররা কিন্তু একেবারে চুপসে গিয়েছিলেন। এরপর যখন ওরা ওমানের বিপক্ষে জিতল তখন কিন্তু তারা মনে করেছে এই যে সমালোচনা চলছে কথাবার্তায় তার একটা জবাব দেওয়ার সময় এসেছে। আমার মনে হয় সেখানে আরেকটা ভুল হয়েছে। এটা ছিল ক্রিকেটারদের মস্ত বড় একটা ভুল। ক্রিকেটারদের বুঝতে হবে যখন প্রশংসা পাবেন তখন কিন্তু সমালোচনাটাও হজম করতে জানতে হবে। সেই সহনশীলতা থাকতে হবে প্রতিটি ক্রিকেটারের। যেটি এই বিশ্বকাপে এখন অব্দি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে আমরা পাইনি। তারা দেখেছি পাল্টা জবাব দিয়েছেন। মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম সবাই জবাব দিয়েছেন। কথাবার্তায় মাঠ গরম করার চেষ্টা করেছেন। সেই উত্তাপেই পুড়ে ছাই দলের পারফরমেন্স, পুরো দলের ক্রিকেট। 

মাঠের বাইরে এতো বেশি প্রতিপক্ষকে তো সিনিয়র ক্রিকেটাররা একপ্রকার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছেন। এটা করা তাদের একদমই উচিত হয়নি। 

এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে পারত টিম ম্যানেজমেন্ট। কোনো ক্রিকেটার যদি সমস্যায় পড়েন, তখন টিম ম্যানেজমেন্টের কাজ হলো সেটি ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু বিশ্বকাপে আমরা সেটি দেখছি না। একটা দলকে চালানোর জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে যে ধরনের একটা লিডারশিপ দরকার ছিল; কখনো বোঝানোর প্রয়োজন ছিল, কখনো শাসনের প্রয়োজন ছিল, সেটা দেখাই যায়নি। এই কারণেই আমার মনে হয় দলের এই অবস্থা হয়েছে। 

ক্রিকেট মানেই হলো চাপ। ক্রিকেটে প্রতিটা মুহূর্তে প্রেশার রয়েছে। আপনাকে সেই প্রেশারটা নিতে হবে। একজন ক্রিকেটার হওয়ার শর্তই হলো, সেই প্রেশারটা চাপা দিয়ে আপনাকে খেলতে হবে। আপনি যদি বাইরের সমালোচনা সহ্য করতে না পারেন, ফেসবুকে কে একটা কমেন্ট করল সেটা যদি আপনার জন্য বেশি কিছু হয়ে যায় তাহলে মাঠে যে ২০ হাজার দর্শক থাকে আর মাঠের বাইশ গজে যখন বিশ্বসেরা বোলার বল করতে থাকে তখন সেই প্রেশার আপনি সহ্য করবেন কী করে! সেই চাপেই তো ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছেন।

ক্রিকেটারদের মাঠের বাইরে কী হচ্ছে সেটি পুরোপুরি ভুলে যেতে হবে। ক্রিকেটারদের কাজ হচ্ছে মাঠে পারফর্ম করা। মাঠে জেতা। কথায় নয়, কাজে জেতা।

এটি/এনইউ