নয়নাভিরাম, দৃষ্টিনন্দন নাকি অনিন্দ্য সুন্দর? ঠিকঠাক বোঝানো যাচ্ছে না আসলে। কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? খুঁজে পাচ্ছি না। শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ যেন সৃষ্টির বিস্ময়। আসলে গল্প তো আর এমনি ছড়িয়ে পড়ে না। সাত সুমুদ্দুর-তের নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে বসেও নামটা কানে এসেছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে পা রাখার আগেই পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের খেলার ফাঁকে যাব এই মসজিদটিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহদের ম্যাচটি দেখার আগে মঙ্গলবার এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

দুবাই থেকে আবুধাবি প্রায় ১৪০ কিলোমিটারের পথ। তবে এখানকার পথ-ঘাট বাংলাদেশের মতো নয়। জ্যামও তেমন নেই। আবার হাইওয়েও আঁকাবাঁকা নয়। সরল রেখার মতো রাস্তার লেন। আমাদের ড্রাইভার ইমরান প্রায় পুরোটা সময় স্টিয়ারিংয়ে হাত না দিয়েই গাড়ি চালালেন। ফোনে সারাক্ষণই কার সঙ্গে যেন চলেছে গল্প। বুঝতে পারলাম, কেউ অপ্রয়োজনে লাইন পরিবর্তন করে না। লম্বা সেই পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টা দেড়েকের বেশি সময় লাগল না।

ম্যাচের ভেন্যু আবু জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়াম না গিয়ে শুরুতেই গেলাম গ্র্যান্ড মসজিদে। আমিরাতের প্রয়াত রাষ্ট্রপ্রধান জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের নামে নামাঙ্কিত। ৩০ একরের বিশাল মসজিদ এলাকাতে পা রাখতেই মনে হলো, যেন কোন টুরিস্ট স্পটে এসে পা রেখেছি। চারদিকে পর্যটক। পশ্চিমা দেশের মানুষের সংখ্যাই বেশি। আরব আর মুসলিম সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে অনেকেই আমিরাতের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে হাজির। অবশ্য ছোট পোশাকে মসজিদ এলাকাতে প্রবেশের অনুমতিও নেই।

আমাদের ড্রাইভার ইমরান প্রায় পুরোটা সময় স্টিয়ারিংয়ে হাত না দিয়েই গাড়ি চালালেন। ফোনে সারাক্ষণই কার সঙ্গে যেন চলেছে গল্প। বুঝতে পারলাম, কেউ অপ্রয়োজনে লাইন পরিবর্তন করে না। লম্বা সেই পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টা দেড়েকের বেশি সময় লাগল না।

আবু জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদটি দেখতে হলে সবার আগে টিকিট কিনতে হবে। অবশ্য বিনামূল্যেই মেলে সেটি। তারপর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে পা রাখার পালা মসজিদে। নিরাপত্তা বলছি এ কারণে, এখানে পা রাখার আগে বেশ কয়েকটি স্ক্যানিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেটি পেরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে করা টানেলে হেঁটে পা রাখতে হয় মসজিদের ঠিক সামনে। অবশ্য যারা সেই পথে হেঁটে যেতে চান না তাদের জন্য ব্যবস্থা আছে বিশেষ গাড়ির।

আমরা অবশ্য হেঁটেই চলে আসি গ্র্যান্ড মসজিদের ঠিক সামনে। এখানে পা দিয়েই মনে হলো যেন নতুন কোনো ভূবনে চলে এসেছি। একদিকে চোখ মেললেই আবুধাবি শহরের একটা অংশের দেখা মেলে। অন্যদিকে সুবিশাল মসজিদ। যার সামনে টলমলে নীল জল। চলতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন অনেক পর্যটক। ছবি তোলার জন্য নানা ব্যবস্থাও করে রাখা আছে। সেই সুযোগটা তাহলে সবাই কেন হাতছাড়া করবেন!

মসজিদটি যেমন বিশাল তেমনি এর সৌন্দর্য মনকাড়া। পাশ থেকে একজন বলছিলেন, এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম মসজিদ। ৩৮টি প্রখ্যাত ঠিকাদার কোম্পানির প্রায় ৩০ হাজার দক্ষ কর্মীর হাতে গড়া সুন্নী মুসলিমদের এই উপাসনালয়। যেখানে ইতালি, জার্মানি, মরক্কো, পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান, চীন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস আর খোদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের নানা পণ্য, কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে। 

একদিকে চোখ মেললেই আবুধাবি শহরের একটা অংশের দেখা মেলে। অন্যদিকে সুবিশাল মসজিদ। যার সামনে টলমলে নীল জল। চলতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন অনেক পর্যটক।

মসজিদটির পরতে পরতে শিল্পের ছোঁয়া। এ কারণেই গোটা বিশ্বের পর্যটকদের কাছেও এটি অন্যতম জনপ্রিয় এক জায়গা। মাথা তুলে উপরে তাকাতেই দেখলাম চার কোণে চারটি মিনার। যেখানে মনে হচ্ছে ফুল ফুটে আছে। পুষ্পশোভিত নকশা আলাদা করে নজর কেড়েছে। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৩৫১ ফুট। 

গুগল ঘেটে জেনে নিয়েছি, দীর্ঘস্থায়ী মার্বেল পাথর, মূল্যবান স্ফটিক পাথর, সোনা ও মৃৎশিল্প ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে মসজিদের এককেটি অংশ। এই নকশায় মুঘল আর মুরিস মসজিদ, গম্বুজ বিন্যাস ও ফ্লোর বিন্যাসে বাদশাহি লাহোর মসজিদের একটা ছায়া রয়েছে। এখানে ফুটে উঠেছে ২০০ বছরের আরব ঐতিহ্য। মসজিদটিতে আছে সব মিলিয়ে ৮২টি গম্বুজ। প্রতিটিতেই আছে স্বেত মার্বেল। মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। শেষ হয় ২০ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে।

মুগ্ধ হওয়ার মতো এর ক্যালিওগ্রাফি। যা কি না সংযুক্ত আর আমিরাতের মোহাম্মদ মান্দি আল তামামি, সিরিয়ার ফারুক হাদ্দাদ এবং জর্দানের মোহাম্মদ আলামের অবদান। এই সৌন্দর্যের কারিগর তারা। পর্যটকরাও সেইসব নান্দনিকতা ফ্রেমে বন্দি করে রাখছেন। ছবি তোলা, ভিডিও করা সবার জন্যই উন্মুক্ত। তবে ফেসবুক লাইভ কিংবা ব্লগাররা সেখান থেকে সরাসরি কিছু করতে গেলে ছুটে আসবেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। 

আমরা যখন পা রাখলাম, তখনই জোহরের নামাজ শুরু। মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল সুমধুর কণ্ঠ। এখানে নামাজ পড়ে আসার সুযোগটা মিস করলেন না বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা দৈনিক দেশ রূপান্তরের সাংবাদিক নাঈম শিহাব। অন্যরকম তৃপ্তি নিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘খুবই সুন্দর মসজিদ। এর আগে আমি ওমানের সুলতান কাবুজ মসজিদ দেখেছি। এটার নান্দনিকতা বা ডিজাইন, নির্মানশৈলী ভিন্ন। এখানে মসজিদ কিছুটা ছোট হলেও বাইরের পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ!’

মুগ্ধ হওয়ার মতোই বিষয়। শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদের মূল নামাজের কক্ষটিতে রয়েছে ইরানী শিল্পী আলী খালিদির ডিজাইনে বিশ্বের বৃহত্তম গালিচা। যা ৬০৫৭০ বর্গফুট আর কার্পেটের ওজন ৩৫ টন। নিউজিল্যান্ড ও ইরানের উল থেকে দুই বছরের পরিশ্রমে তৈরি করা হয় এই গালিচা।

মাথা তুললেই মসজিদে দেখা মিলবে ঝাড়বাতি। লাখ লাখ পাথরের তৈরি পৃথিবীর বৃহত্তম ঝাড়বাতিটি রয়েছে আবুধাবির এই মসজিদে। যেটির ব্যস ৩৩ ফুট আর উচ্চতা ৪৯ ফুট। মসজিদটির আঙিনায় সবাই প্রবেশ করতে পারছেন। এখানে কে হিন্দু, কে খ্রিস্টান কিংবা অন্য ধর্মের সেসব যাচাই করা হয় না। সবার জন্য দরজা খোলা। ১৭ হাজার বর্গমিটার মার্বেল মোজাইকে জুতো পায়েই এই মাথা থেকে ওই মাথা ঘুরে বেড়ানো যায়। ঘুরে বেড়াতে গিয়ে আমরা কিছুটা ক্লান্ত হয়েও পড়েছিলাম। আবুধাবিতে দুবাইয়ের চেয়েও যেন বেশি গরম। 

তবে ক্লান্ত হয়ে উঠলে বসার জায়গার অভাব নেই। আর নামাজ আদায় করার জায়গাটা নারী-পুরুষ আলাদা করে রাখা আছে। যেখানে সব মিলিয়ে ৪০,০০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। জুমা ও ঈদে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ আদায় করতে পারেন নামাজ! এখানেই শেষ নয়, অত্যাধুনিক এই মসজিদে রয়েছে সুবিশাল এক লাইব্রেরি। সেই সংগ্রহশালায় মুসলিম বিশ্বের ঐতিহ্য আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলতে রাখা হয়েছে নানা বই। আরবি, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, স্প্যানিশ, জার্মান বিশ্বের প্রধানতম সব ভাষার বইয়ের দেখা মিলবে এখানে। 

এভাবেই গ্র্যান্ড মসজিদের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে কখন যে সময় কেটে গেল টেরই পেলাম না। মাঠে ফিরতে হবে। তাই চটজলদি ফেরার পথ ধরলাম। ৪ হাজার ৬৬৬ কোটির বেশি টাকায় নির্মিত এই মসজিদটি থেকে বেরিয়ে আসার পথে কমপ্লেক্সের ভেতরেই দেখা মিলল পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকান। 

হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, একটা ছোট্ট দোকান থেকে ৫০০ মিলিলিটারের একটা পানির বোতল নিতেই দাম চাইল ১১ দিরহাম। যেটি অন্য দোকানে ১ দিরহামের বেশি নয়! তবে বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখে মনে হলো, একটা মসজিদও হয়ে উঠতে পারে একটা পর্যটন স্পট। যেটি করে দেখিয়েছে আরব আমিরাত। 

ফিরতি পথে দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ পারভেজ জানাচ্ছিলেন তার অভিজ্ঞতা, ‘এখানে এসে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যেটি চোখে পড়লো সেটি হলো, এখানে সব ধর্মের মানুষের মিলন মেলা। আমাদের দেশে হয়তো আমরা এটা কল্পনাও করতে পারি না। এখানে নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন এমন কোন ধর্ম নেই যে ধর্মের মানুষের উপস্থিতি এখানে ছিল না। এখানে সব ধর্মের মানুষের জন্যই সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগটা রয়েছে। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে।’

একদমই ঠিক। উদার রাষ্ট্র এভাবেই হয়ে ওঠে। যে মানুষটি এমন একটা মসজিদের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে মানুষটি এমন সৌন্দর্য লালন করেছেন হৃদয়ের গহীনে, সেই রাষ্ট্রনায়ক শেখ জায়েদকে এখানে এই গ্র্যান্ড মসজিদের আঙিনায় দাফন করা হয়েছে, এখানেই চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম রাষ্ট্রপতি।

এটি/এমএইচ/টিআইএস/জেএস