চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কিছু পথ এগোলে সামনে চোখে পড়ে বিশাল বঙ্গোপসাগর। হাইওয়ের দু’পাশে চলছে উন্নয়ন কাজ। রাস্তা প্রশস্ত করার পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসার পর বঙ্গোপসাগরের দেখা পেতেই সহযাত্রী একজন আঙুলের ইশারায় দেখালেন, এখান থেকে সোজা একটা রেখা টেনে দিলে সেটি ভারতের দিঘায় গিয়ে ঠেকবে। তবে চাইলেই তো আর রেখা টানা সম্ভব নয়!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে ক্রান্তিকাল চলছে সেখান থেকে উত্তরণ দরকার যত দ্রুত সম্ভব। ঘোর আমানিশায় ডুবে আছে যেন লাল-সবুজের ক্রিকেট। মাঠ ও মাঠের বাইরে যে সময় পার হচ্ছে, সেটি একেবারেই ভালো বার্তা দিচ্ছে না। তবে রাতারাতি সব ঠিক করে ফেলা সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে সোজা রেখা টানা।

বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ঘরে ফিরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ০-৩ ব্যবধানে হার। এরপর আজ প্রথম টেস্টের শুরুতেই নেই ৪ উইকেট! দুরবস্থা যেন কাটছেই না টাইগার ক্রিকেটে।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। সেই দায়িত্বই যেন কাঁধে তুলে নিলেন লিটন দাস আর মুশফিকুর রহিম। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম দিনে চট্টগ্রামে লিটন-মুশফিকের দাপুটে ব্যাটিংয়ে কিছুটা আলোর দিশা খুঁজে পেয়েছে লাল-সবুজের দল।

সাগরিকার পাড়ে ঠান্ডা মাথার ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানি বোলারদের শাসন করেন লিটন-মুশফিক। দাপুটে ব্যাটিংয়ে দুজনের পার্টনারশিপ থেকে আসে অবিচ্ছেদ্য ২০৪ রান। প্রথম দিন শেষে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ ২৫৩ রান। টেস্টে অভিষেক সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া লিটন ১১৩ আর সেঞ্চুরির অপেক্ষায় থাকা মুশফিক ৮২ রান নিয়ে অপরাজিত আছেন।

সকালে টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। ইনিংসের প্রথম ওভারেই শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে কোন রান না করে ফিরতে পারতেন ওপেনার সাদমান ইসলাম। তবে উইকেটরক্ষক রিজওয়ানের হাতে বল ধরা পড়ার আগে যে সাদমানের ব্যাট ছুঁয়ে গেছে সেটি বুঝতে পারেনি সফরকারীরা। এ যাত্রায় বেঁচে যান সাদমান। তবে সুবিধা করতে পারেননি। হাসান আলীকে উইকেট দিয়ে ফেরেন ১৪ রানে।

তার আগে অবশ্য ইনিংসের পঞ্চম ওভারে শাহিন শাহ আফ্রিদির লাফিয়ে ওঠা বলে লাইন হারান সাইফ। যেটি জমা পড়ে আবিদ আলীর হাতে। টি-টোয়েন্টি সিরিজে ব্যর্থ এই ব্যাটসম্যান আউট হন ১২ বলে ১৪ রান করে। ১৪ রানের গেরো কাটাতে পারেননি নাজমুল হোসেন শান্তও। নড়বড়ে ব্যাটিংয়ে ফাহিম আশরাফকে উইকেট দেন টেস্টে ‘অটো চয়েজ’ বনে যাওয়া শান্ত। 

পয়া ভেন্যু চট্টগ্রামে অধিনায়ক মুমিনুল হকের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। তবে এ যাত্রায় সতীর্থদের পথেই হাঁটলেন তিনি। ধীর-লয়ে ইনিংস শুরু করলেও সাজিদ খানকে উইকেট দেন ৬ রান করে। ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ।

এর পরের গল্পটা কেবলি লিটন আর মুশফিকের।

৬৯ রানে দুপুরের খাবার খেতে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে দুই ব্যাটসম্যান টেনে তোলেন তৃতীয় সেশনে। চা বিরতির আগে স্বপ্নের মতো একটি সেশন পার করে বাংলাদেশ দল। এ সেশনে ১২২ রানের অবিচ্ছেদ্য জুটিতে ব্যক্তিগত ফিফটির স্বাদ পান দু’জনই। তবে সেখানেই থেমে যাননি লিটন-মুশফিক। আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ১৭১ রান নিয়ে চা বিরতিতে যায় বাংলাদেশ দল।

লিটন ৬২ ও মুশফিক ৫৫ রান নিয়ে তৃতীয় ও শেষ সেশনের খেলা শুরু করেন। তবে বিপদে হতে পারত ইনিংসের ৬৫তম ওভারে। ব্যক্তিগত ৬৭ রানে জীবন পান লিটন। আফ্রিদির করা বলে পুল করেন লিটন, বল সোজা মিড উইকেটে দাঁড়ানো সাজিদ খানের হাতে। কিন্তু তা লুফে নিতে ব্যর্থ হন সাজিদ। 

জীবন পেয়ে আর পেছন ফিরে তাকাননি লিটন। ঠান্ডা মাথার ব্যাটিংয়ে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। বাঁহাতি স্পিনার নুমান আলির করা ৭৮তম ওভারের তৃতীয় বল মিড অফে ঠেলে দিয়ে ছুঁয়েছেন তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার। পঞ্চাশ রানের সময় উদযাপন না করলেও সেঞ্চুরির পর ব্যাট তুলে সতীর্থদের অভিবাদনের জবাব দেন লিটন।

শাহিন শাহ আফ্রিদি, হাসান আলী, নোমান আলী, সাজিদ খানরা হতাশায় মুষঢ়ে পড়েন লিটন-মুশফিকের সাবলীল ব্যাটিংয়ের কাছে। এতে অপেক্ষা বাড়ল অভিষেক হওয়া ইয়াসির আলী রাব্বির। প্রথম সেশন থেকে দিনের বাকিটা সময় প্যাড পরে বসে থাকতে হলো তাকে। যদিও আলোক স্বল্পতার কারণে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ ওভার আগেই শেষ হয় প্রথম দিনের খেলা।

তৃতীয় ও শেষ সেশনটিও দারুণ কাটল স্বাগতিকদের। এই সেশনে ২৬ ওভার ব্যাট করেন লিটন-মুশফিক। কোনো উইকেট হারাতে হয়নি। দাপুটে ব্যাটিংয়ে দুজনের পার্টনারশিপ থেকে আসে অবিচ্ছেদ্য ২০৪ রান। যেখানে চট্টগ্রামে পঞ্চম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটিতে নাম তোলেন লিটন-মুশফিক। যা টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষেও সর্বোচ্চ।

টেস্টে অভিষেক সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া লিটন ১১টি চার ও ১ ছক্কায় ১১৩ আর সেঞ্চুরির অপেক্ষায় থাকা মুশফিক ১০টি চারের মারে ৮২ রান নিয়ে আগামীকাল (শনিবার) দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরু করবেন।

টিআইএস/এনইউ/জেএস