পাকিস্তানের একটা টিভি শো দেখছিলাম। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে তা নিয়ে আলোচনা। তাইজুল সেদিন ১৯ ওভার বোলিং করেছিলেন, উইকেটের দেখা পাননি। তবু তাঁর নিখুঁত ও নিয়ন্ত্রিত বোলিং দেখে পাকিস্তানের সাবেক দুই ক্রিকেটার আকিব জাভেদ ও রশিদ লতিফ বেশ প্রশংসা করলেন তাইজুলের। ভিনদেশিদের চোখে আমরা কেমন, জানার আগ্রহটা থাকে সবসময়ই। সেদিন তাইজুলের প্রশংসা শুনে যে কত আনন্দ লেগেছে!

সে অনুষ্ঠানের শেষ দিকে উপস্থাপক ম্যাচের ফলাফল প্রেডিকশন পর্বে গেলেন। রশিদ লতিফ বললেন, বাংলাদেশ ভুল করবে, তাই হারবে। পরদিন বাংলাদেশ কোন ভুল করলো না, দ্বিতীয় সেশন পর্যন্ত! আগেরদিন মুমিনুলের কিছুটা রক্ষণাত্মক কৌশল বেছে নেওয়াটাও তখন ভুল মনে হলো না! দ্বিতীয় দিনে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে যখন উইকেট পড়ছিলো না, তখন বাংলাদেশ রান বাঁচানোর চিন্তায়ই চলে গিয়েছিল। যা পরে ভুল না মনে হওয়ার কারণ, আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ে গিয়ে ত্রিশ-চল্লিশ রান বেশি দিলে হয়তো তার চড়া মূল্যই দিতে হতো।

আর বড় কথা, পিচও বোলারদের পক্ষে কথা বলছিল না খুব একটা, তারপরেও তাইজুল-এবাদত ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা দিয়েছেন। যার ফল মিলেছে অবশ্য পরদিন। কিন্ত তৃতীয় দিনের শেষ সেশনের গল্পটা ওই একই থাকলো, টপ অর্ডারের ভঙ্গুর দশা দেখতে হলো আবারও! 

প্রথম ইনিংসে প্রথম ঘণ্টা না পেরোতেই চার উইকেট হারিয়ে বিপদের মহাসাগরে পড়া বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছিলেন লিটন-মুশফিক। পঞ্চাশের কম রানে চার উইকেট হারিয়ে দুই’শ রানের বড় জুটি এর আগে হয়েছিল পাচঁবার। মুশফিক-লিটন সেদিন গড়লেন আরেকটি, মাঝে লিটন সাদা পোশাকে প্রথমবারের মতো পেলেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারের দেখা। মুশফিক সেঞ্চুরি থেকে নয় রান দূরেই থেমেছেন। তবে বাংলাদেশের ফিরে আসার গল্পে ছিল তাদের নিজেদের ফিরে আসার অংশও! 

লিটন-মুশফিক জুটিই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল লড়াইয়ের রসদ/গেটিইমেজ

লিটনের সেঞ্চুরির পর কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে হাসিমুখে উদযাপনের দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। ডমিঙ্গোর অধীনে সব ফরম্যাট মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা হয়েছে লিটন দাসের। টেস্টে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এবছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করলেও রঙিন পোশাকে ঠিক রঙিন ছিলেন না লিটন। 

তার সামর্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে ডমিঙ্গো-প্রিন্সদের। সেই সামর্থ্যে আস্থা রেখে ফলাফল না পেয়ে নিয়মিত সুযোগ দিয়ে গেলে তাদের দিকেও তো আঙুল উঠবেই। পোশাকের রঙ রঙিন হোক আর সাদা, রানে ফেরাটা স্বস্তির। লিটনের সাথে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন ডমিঙ্গোরাও। 

মুশফিকের জন্যেও তো এ টেস্টের আগে সময়টা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বড্ড কঠিন। টি-টোয়েন্টি দল থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বিশ্রামের কথা বলে, সেটাকে আপনি ‘বাহানা’ বললে ভুল হওয়ার কথা নয়। কারণ তাতে আপত্তি জানিয়ে তিনি পরে বলেছিলেন বিশ্রাম নিতে চাননি। যে কারণ দেখিয়ে বিশ্রামের কথা বলা হয়েছিল, সেই টেস্ট ক্রিকেটে অবশ্য মুশফিক তার সেরাটাই দিতে পেরেছেন। মুশফিকের সাথে ডমিঙ্গোর যে দ্বন্দ্বের গুঞ্জন বাংলার ক্রিকেট আকাশে ঘুরছিল, তা সত্যি হয়ে থাকলেও অন্তত মুশফিক টেস্টে নিজের জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগটাকে আপাতত দূরেই ঠেলে দিলেন। 

বাংলাদেশ ম্যাচে ছিলই এই দু’জনের খাতিরে। তবে ম্যাচ শেষে অধিনায়ক মুমিনুল তাদের সঙ্গে যোগ করতে ভোলেননি তাইজুলের নাম। নিখুঁত ও শৃঙখলাবদ্ধ বোলিংয়ের দুর্দান্ত এক প্রদর্শনী দেখিয়েছেন তিনি। সাত উইকেট নেওয়া তাইজুলের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন ভিনদেশি আকিব জাভেদও। সেই টিভি শোতে তিনি তাইজুলকে বিশ্বের সেরা একজন বাঁহাতি স্পিনারও বলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। নিজ দেশের একজনের নামে এই প্রশংসা শুনে তখন কেমন লেগেছিল তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন! 

রশিদ লতিফও তাইজুলের স্পিন সক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের সাবেক উইকেটকিপার যে বাংলাদেশের ভুলের কথা বলেছিলেন, সেই ভুলের শঙ্কাটা আসলে ছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়েই। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ব্যর্থতার গল্পে আসেনি কোন বদল। তাইজুল, লিটন, মুশফিকদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য তাই বৃথাই গেছে। ম্যাচ শেষে মুমিনুল বলেছিলেন, বাংলাদেশের জয়ের জন্য বিশেষ করে দরকার হয় দলীয় পারফর্ম্যান্সের। অবশ্য ব্যক্তিগত পারফর্ম্যান্সগুলো বৃথা গেছে বলাও যায় না। কারণ মুশফিক-লিটনের ফেরাটাও যে সুসংবাদ! 

এ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় না পেলেও আট উইকেটের হার ‘একতরফা’ ম্যাচের যে ধারণা দিচ্ছে, সেটা অনেকাংশেই সঠিক নয়। বাংলাদেশ ম্যাচ ছিল অনেকক্ষণই, আর পাকিস্তানের এই জয়ে তাদের দুই ওপেনার আবিদ আলী ও আব্দুল্লাহ শফিকের অসামান্য ব্যাটিংয়ের কৃতিত্ব না দেওয়াটাও যে বড় অনুচিত হয়ে যায় যেন। টেস্টের সাগরে এতদিন হাবুডুবু খাওয়া এবাদতের এ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে নিখুঁত লাইন-লেংথে বল করে যাওয়া আশা জাগায়, অভিষেকে ইয়াসিরের ব্যাটিংও তেমনি। 

আবার সাইফ, সাদমান, শান্তদের ব্যাটিং অবশ্য হতাশই করে। মুমিনুল ম্যাচ শেষে তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এবাদত-রাহীদের উন্নতি করতে হলে বেশি বেশি ম্যাচ খেলা দরকার। সেটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্ত বাংলাদেশে ফরম্যাটভেদে গুরুত্বের অগ্রাধিকারের তালিকায় সবার নিচের দিকেই তো থাকে লাল বলের ক্রিকেট। আর ম্যাচ যা খেলার সুযোগ পান, তাতেও ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে তো প্রশ্নের শেষ নেই। রাসেল ডমিঙ্গোও সেদিন বলছিলেন, টেস্টের সাথে বাংলাদেশের ফার্স্ট ক্লাসের বিস্তর ফারাকের কথা। সেই ফারাক কবে যে কমবে!

আপাতত আমরা বরং তাইজুল-লিটনদের ব্যক্তিগত ঝলকেই আনন্দ খুঁজে নেই। ভিনদেশিদের মুখে আমাদের একজনের প্রশংসা শুনেই আনন্দিত হই।

এনইউ