স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এক, এক করে কেটে গেল ৫০টি বছর। মাইলফলক অতিক্রম করল বাংলাদেশ। এই অর্ধশতক মাঠের ক্রিকেটের নয়, এই অর্জন লাল-সবুজের বাংলাদেশের।

এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের গল্প লেখা হয়েছে ১০ মাসে। ৫০ বছর পর এসে ১৯৭১ সালের বর্বরোচিত ঘটনা এখনো জীবন্ত। অনেকেই বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু এই অর্জন কি সহজ ছিল? লাখো শহিদের রক্ত, নির্ভয়ে সঁপে দেওয়া নিজেদের প্রাণ, মা-বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন, নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রা- স্বাধীনতা তো আর পায়ে হেঁটে আসেনি!

এ দেশের মুক্তিকামী জনতার হাজারো গল্প আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গল্পের ঝাঁপি আরো বেশি প্রসিদ্ধ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে এ দেশের নিজস্ব কোন ক্রিকেট দল ছিল না। যে দু-চারজন সুযোগ পেতেন, তারা খেলতেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান দলে। পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট অভিষেকের হাতছানি ছিল রকিবুল হাসানের। তবে ব্যক্তিগত অর্জনের তোয়াক্কা করেননি তিনি। পাকিস্তানের হয়ে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে নেমে যে সাহসিকতা তিনি দেখান, সেটি তাকে নিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও রকিবুলের সে স্মৃতি এখনো জীবন্ত। হাজারবার বললেও যে কথাগুলো কখনো ‘পুরোনো’ হয় না। আরো একটি ১৬ ডিসেম্বর, আরো একটি বিজয়দিবস। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করার মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে পুরোনো সেই কথার মালা নতুন করে খুলে বসলেন রকিবুল। পাকিস্তানের হয়ে খেলতে নেমেও ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার লাগিয়ে যে বীরত্বের পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে বারুদের মতো জ্বালিয়ে দেয়।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের টেস্ট দলে ডাক পান রকিবুল। স্কোয়াডে থাকলেও একাদশে সুযোগ হয়নি। দ্বাদশ খেলোয়াড় হয়ে থাকতে হয় তাকে। তার দু’বছর পর ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসে কমনওয়েলথ একাদশ। বিশ্ব একাদশের আদলে গড়া দলটির বিরুদ্ধে অনানুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট হাতে ওপেন করার সুযোগ পান রকিবুল। 

সেদিন তার ব্যাটে ছিলো একটি স্টিকার, বাংলাদেশের মানচিত্রর সঙ্গে দু’টি শব্দ-‘জয় বাংলা’। সে স্মৃতিচারণ করে রকিবুল বললেন, ‘সে ম্যাচের আগে পাকিস্তানি ক্রিকেটারের যে ব্যাট দেওয়া হয়েছিল, আমাকে সে ব্যাট দেওয়া হয়নি। তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক সংবলিত ব্যাট। আমি জয় বাংলা স্টিকার সংযুক্ত ব্যাট নিয়ে খেলতে নামি। সবুজ রঙের তিন কোণা স্টিকার। রিভার্সে ওপরে সাদা কালিতে লেখা ছিল জয় বাংলা। এ ঘটনার পর পুরো স্টেডিয়াম গর্জে উঠেছিল জয় বাংলা স্লোগানে। আর সেই প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। যেটা আমি পরে জানতে পারি।’

সঙ্গে বলেন রকিবুল, ‘সবাই এই স্টিকারগুলো লাগাতো দেয়ালে, গাড়িতে কিংবা ব্যাগে। আমি আমার গ্রে-নিকোলস ব্যাটের স্টিকারটার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাটাও জুড়ে নিলাম। একটা স্টেটমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। দশজন পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে খেলতে নেমেছি, আর আমার ব্যাটে জয় বাংলা লেখা স্টিকার।’

সোর্ড বা তলোয়ার ছিল পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক। পাকিস্তান দলের বাকি ১০ সদস্য ব্যাটে এই স্টিকার নিয়ে খেলতে নামেন। স্বাধীনচেতা রকিবুল হাসানের কাছে বিষয়টি ভালো লাগেনি। মেনে নিতে পারেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল ছিলেন রকিবুল হাসানের বন্ধু। কামাল তার জন্য স্টিকার সংগ্রহ করে দিলেন। সেই ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে মাঠে নামেন রকিবুল।

রকিবুল বলেন, ‘আমার সুযোগ পাওয়ার কথা শুনে ম্যাচের আগের দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন শেখ কামাল। কামাল ভাই আমাকে অভিনন্দিত করলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে আমি তাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানাই। তিনি খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন। সে সময়ের ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন জালালকে পাঠালেন আওয়ামী লীগ অফিসে স্টিকার নিয়ে আসতে। জালাল স্টিকার নিয়ে এলে কামাল ভাই নিজ হাতে সেই স্টিকার আমার ব্যাটে লাগিয়ে দেন।’

রকিবুলের বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি উদ্দীপ্ত সাহসের ইতিহাস নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেন। পরদিন সবক’টি সংবাদপত্রে গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর প্রকাশিত হয়। এমনকি লন্ডনের কয়েকটি পত্রিকায়ও। চারিদিকে হই-চই। আলোচনা শুরু হয় রকিবুল নিয়ে। 

পরবর্তীতে রাকিবুল চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল গড়তে। সে উদ্দেশে ভারতে যাত্রা করেন তিনি, ‘২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানীরা নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর হামলা চালাতে শুরু করে, নির্বিবাদে গুলি করে লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করতে শুরু করলো তখম আমিও ভাবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিব। দেশকে স্বাধীন করতে ব্যাট ছেড়ে অস্ত্র হাতে নিব। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ শহীদের সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, তুই ভারতে চলে যা, আমিও সেখানেই অবস্থান করছি।’

সঙ্গে যোগ করেন রকিবুল, ‘ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মত ক্রিকেট দল তৈরির কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ক্রিকেট দল গঠন করা সম্ভব হয়নি। আমি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথেই থেকে গেলাম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল খেললেন আমাদের ফুটবলাররা।’

টিআইএস/এটি